ঢাকা এখন ‘তপ্ত দ্বীপ’

ঢাকা এখন ‘তপ্ত দ্বীপ’

নানামুখী চাপে দিন দিন ‘তপ্ত দ্বীপে (হিট আইল্যান্ড)’ পরিণত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। তাপমাত্রা বাড়ার যতগুলো উপাদান আছে, এর সবগুলোই আছে এ নগরীতে। অন্যদিকে তাপ কমানোর উদানগুলো কমতে কমতে এখন একেবারে নিঃশেষ হওয়ার পথে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় ঢাকাকে ‘বসবাসের অযোগ্য’ ঘোষণা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, সরকারি দাপ্তরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানÑ সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উন্মূল মানুষের গন্তব্যও হয়ে উঠছে ঢাকা। মানুষের বাড়তি চাপে এখানে গড়ে উঠছে বাসস্থানসহ নানা স্থাপনা। ফলে উন্মুক্ত প্রান্তর কমছে, গাছপালা ও জলাশয় আশঙ্কাজনক হারে কমছে, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, শহরের অবকাঠামো ও রাস্তাঘাট সূর্যের আলোকরশ্মি শোষণ করে নেওয়ার ফলে নগর থেকে উত্তাপ দূর হচ্ছে না কিছুতেই। ঢাকা হয়ে উঠছে একটি তপ্ত দ্বীপ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সেই ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) তপ্ত দ্বীপ বা আরবান হিট আইল্যান্ড সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগর এলাকার তাপমাত্রা স্বভাবতই অত্যধিক হয়ে থাকে। কারণ নগর এলাকায় স্থাপিত ইট-সিমেন্ট-কাচের অবকাঠামোসমূহ (রাস্তা, সুউচ্চ ভবন) সূর্য থেকে আগত আলোকরশ্মি শোষণ করে। এর ফলে এসব অবকাঠামোর পৃষ্ঠতল অত্যধিক তাপ ধারণ করে থাকে। তাছাড়া শিল্প কার্যকলাপ, গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমেও নগর এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে যায়।

পাঁচ ধরনের ক্ষতিকর গ্যাসের স্তর

সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের ক্ষতিকর গ্যাসের স্তর তৈরি হয়েছে। এতে ঢাকার মাটি ও বাতাস আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান কাচের বিল্ডিং ও বিদ্যুতের বাড়তি ব্যবহার শহরকে উত্তপ্ত করছে। এতে ঢাকা এরই মধ্যে তপ্ত দ্বীপে পরিণত হয়েছে। 

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তাপ বাড়ার যত কারণ, সবই ঢাকায় আছে। কিন্তু তাপ কমানোর যত উপাদান আছে, তার কোনোটিই নেই। ধারণক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ বাস করছে এ শহরে। ৫ থেকে ৬ লাখ যানবাহনের ক্যাপাসিটি থাকলেও চলছে ১৬ লাখের বেশি। ৪০ থেকে ৪৫ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে শুধু এসির পেছনে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ভূমি শীতল হচ্ছে না। যার কারণে মাটিও তাপ শোষণ করতে পারছে না।’ 

ক্যাপস চেয়ারম্যান বলেন, ‘দিনের বেলায় যে তাপমাত্রা থাকে, রাতের বেলা তা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি রাতের ঢাকাও উত্তপ্ত থাকছে। এগুলো হচ্ছে আরবান হিট আইল্যান্ড প্রক্রিয়ার কারণে। আরবান হিট আইল্যান্ডের যত বৈশিষ্ট্য আছে, তার সবই ঢাকায় বিদ্যমান।’

২৫টি স্থানে তপ্ত দ্বীপ উপাদান

বছর তিনেক আগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে ঢাকা শহরের তাপদাহ নিয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অন হিট ওয়েভ ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক গবেষণা পরিচালনা করে। এতে ঢাকার ২৫টি স্থানকে তপ্ত দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বাড্ডা, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাব, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা, জুরাইন, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, উত্তরা, কামারপাড়া, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, আদাবর, ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া ও মহাখালী এলাকা।

বিদ্যমান নগর এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় (উত্তরা, বসুন্ধরা) বর্তমানে তপ্ত দ্বীপ উপাদানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এলাকার তাপমাত্রা কম। এসব এলাকায় প্রচুর গাছপালা ও খোলা জায়গা থাকায় তেমন তাপ অনুভব হয় না। কিন্তু মতিঝিল, কারওয়ান বাজার ও মগবাজার এলাকায় গাছপালা কম থাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি।

বৃক্ষরোপণ : তপ্ত দ্বীপ প্রক্রিয়া হ্রাসের সেরা কৌশল 

ড্যাপের প্রতিবেদনে তপ্ত দ্বীপ প্রক্রিয়া প্রভাব হ্রাস করার কৌশল নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেÑ তপ্ত দ্বীপ প্রভাব কমানোর জন্য ব্যবহৃত সেরা কৌশলগুলোর একটি হচ্ছে অধিক পরিমাণে গাছপালা রোপণ। বিভিন্ন সবুজ গাছপালা নগর এলাকায় শীতল এবং গরমের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির মাধ্যমে তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলতে পারে। গাছপালা তার ভেতরকার পানিকে বাষ্পীভবন করে এবং ছায়া প্রদানের মাধ্যমে নগর এলাকায় শীতলতা দিতে পারে। এতে নগরের বায়ুদূষণও কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু ঢাকায় দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে গাছপালা কমে আসছে। গত বছর বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ ভাগের কম। তাও এসব এলাকা সীমানাপ্রাচীরসহ নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। 

একই বছর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপ) ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট বিশ্লেষণ করে এক গবেষণায় উল্লেখ করে, ঢাকায় সবুজ এলাকা আছে মাত্র ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে অন্তত ৪৩ শতাংশ সবুজ এলাকা ধ্বংস হয়েছে। একই সময়ে ঢাকা থেকে ৮৫ দশমিক ৮৫ ভাগ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। এই সময়ে নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বেড়েছে ৭৫ ভাগ। অর্থাৎ গবেষণা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সবুজ গাছপালা এবং জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এমনকি পার্ক ও খেলার মাঠসহ খোলা জায়গাগুলো কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানায় বিআইপি।

আলাপকালে বিআইপি সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘গরমের সময় তাপ বেশি থাকে। তবে কিছু এলাকায় মাত্রার চেয়ে বেশি তাপ থাকছে। কোনো এলাকায় সবুজ এলাকা কম থাকলে এবং কংক্রিটের পরিমাণ বেশি থাকলে তাপমাত্রাও বেশি থাকে। অধিক তাপমাত্রার এই এলাকাগুলোই হিট আইল্যান্ড হয়ে ওঠে। ঢাকাও দিন দিন হিট আইল্যান্ড হয়ে উঠছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাসযোগ্যতা ফেরাতে সবুজ এলাকা ও জলাশয় রক্ষা করতে হবে। এ ধরনের এলাকা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

ড্যাপের সুপারিশ 

তপ্ত দ্বীপ প্রক্রিয়া হ্রাস করার লক্ষ্যে ড্যাপের প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় অবশ্যই যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণের শর্ত দিতে হবে। ইমারত নির্মাণের যে সকল উপাদান তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, তা রহিত করতে হবে। বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালায় গাছপালা রোপণের শর্ত দিতে হবে। গ্রিন নেটওয়ার্ক রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে। যেকোনো ধরনের রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করতে হবে গাছপালা রোপণ। নগর জীবনরেখায় বিদ্যমান নির্দেশনা অনুসরণ করে এই বৃক্ষরোপণ করতে হবে। যেসব এলাকায় (প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা) তপ্ত দ্বীপ উপাদানের প্রভাব অত্যধিক, সেসব এলাকায় প্রকল্প নিয়ে গাছ লাগাতে হবে।

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জলাশয় (পুকুর, লেক, খাল ও নদী) সংরক্ষণ করতে হবে। প্রস্তাবিত পার্ক ও খেলার মাঠের বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকা শহরের অতি জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিকল্পনায় সুপারিশকৃত এলাকাভিত্তিক ডেনসিটি জোনিংয়ের নীতি যথাযথ অনুসরণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিমত

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাজউকের বিশদ এলাকা পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ঢাকার সবুজ সংরক্ষণে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা যেমন কম ঘনবসতির শহরের মতো সবুজ দিতে পারব না, তেমনি এখন যেমন আছে তেমনটা চলতে দিতে পারি না। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের সবাইকে তো ঢাকায় জায়গা দিতে পারব না। আমাদের অবশ্যই ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে যেতে হবে।’

রাজউকের প্রধান পরিকল্পনাবিদ এবং ড্যাপ প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ছোট ছোট প্লট করে বিল্ডিং তৈরি করলে খোলা জায়গা থাকে না। যতটুকু জায়গা সবটুকুতে বিল্ডিং করলে কোথায় গাছ লাগাবেন? আর কোথায়ইবা খোলা জায়গা থাকবে? ঢাকার প্রেক্ষাপটে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকার মিডিয়ান ও খালি জায়গায় গাছ লাগানো হচ্ছে। মেয়রের নির্দেশে যেখানে খালি জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে গাছ লাগানো হচ্ছে। এরই মধ্যে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল সচল করা হয়েছে। তাছাড়া খালগুলো পরিষ্কার করে তার চারপাশে গাছ লাগানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ‘খালের পাড়, ফুটপাথ ও সড়ক বিভাজনসহ নগরীর বিভিন্ন জায়গায় চলতি বছর প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। আরও ২ লাখ গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া চলমান।’ সুত্রঃ প্রতিদিনের বাংলাদেশ