জুলাই ৩২: কোটা আন্দোলনের প্রতিরোধ, প্রত্যয় ও প্রহরের দিন

জুলাই ৩২: কোটা আন্দোলনের প্রতিরোধ, প্রত্যয় ও প্রহরের দিন



তানজীম নাঈম: ২০২৪ সালের ১লা আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি প্রতীকী এবং প্রতিবাদমুখর দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দিনটির ব্যতিক্রমী নামকরণই ছিল একটি শক্তিশালী বার্তা—“জুলাই ৩২”। এটি ছিল শুধুমাত্র একটি তারিখ নয়, বরং একটি প্রতিরোধের রূপক, যা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ন্যায়ের দাবিকে আরও বলিষ্ঠ করে তোলে। জুলাই মাসের শেষ দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দমন, নিপীড়ন ও রক্তক্ষয়—সব কিছুর প্রতিবাদে ১ আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার ঢল নামে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, টিএসসি ও অপরাজেয় বাংলার আশপাশ এলাকা ছিল দিনভর উত্তাল। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ পরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তাদের নিহত সহযোদ্ধাদের প্রতি। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, পোস্টার ও স্লোগানের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের ন্যায়ের প্রতি দাবি তুলে ধরেন। "জাস্টিস ফর জুলাই", "আমার ভাই কোথায়?" এবং "জুলাই ৩২-এর বিচার চাই"—এই তিনটি স্লোগান সেদিন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। সামাজিক মাধ্যমে #July32 এবং #JusticeForQuotaVictims ট্রেন্ডিং অবস্থায় পৌঁছে যায়। পত্রিকার শিরোনামে স্থান পায়: “আন্দোলনের এক মাস: ন্যায়ের দাবিতে কাঁদছে বিশ্ববিদ্যালয়”।


এই দিনটিকে কেন্দ্র করে শিক্ষক সমাজ, নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকরাও সরব হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। আইনজীবীদের একটি জোট হাইকোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে রিট আবেদন করেন। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে জানায়, তারা বাংলাদেশের ১৬–২৩ জুলাইয়ের সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন এবং স্বাধীন তদন্তে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। একই দিনে সরকার তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি।


১লা আগস্টের ঘটনাগুলো শুধু একটি দিনের প্রতিবাদ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছিল একটি জাতীয় আত্মসচেতনতামূলক প্রতীক। দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই সেদিন স্মরণসভা, মানববন্ধন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এই প্রতিবাদের আবেগ। রাজধানীর বাইরে থেকেও আসে প্রতিবাদী কণ্ঠ, যেমন বগুড়া শহরে মায়েরা সন্তানদের ছবি নিয়ে মিছিল করেন—"আমার সন্তান কেন নিখোঁজ?" এমন প্রশ্ন করে।


এই আন্দোলনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এর প্রতীকী রূপকল্প ও সাহিত্যিকতা। “জুলাই ৩২” শুধুমাত্র একটি তারিখ নয়, বরং একটি কাল্পনিক দিন যা বাস্তবতা থেকে উঠে এসেছে; এটা যেন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সীমার বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্রসমাজের একটা বিদ্রোহী চিৎকার—একটা সত্যের খোঁজ। এই ধারাবাহিকতায়, অনেকে এদিনটিকে ‘গণপ্রতিরোধ দিবস’ হিসেবেও দেখতে চান। এটা ছিল শোক, প্রতিবাদ ও প্রতিজ্ঞার সম্মিলন, যেখানে চোখের জলে মিলেছে রক্তের ঋণ।


সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে—যেখানে রাষ্ট্র যখন অন্ধ ও বধির, তখন জনগণই সত্যের ভাষ্যকার। "জুলাই ৩২" এখন কেবল তারিখ নয়, বরং ইতিহাসের এক অধ্যায়, যেখানে একটি প্রজন্ম হারিয়েছে বন্ধু, স্বপ্ন ও নিরাপত্তা; কিন্তু হারায়নি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রার্থনার শক্তি। এই কলামে সেই কণ্ঠগুলোকে স্মরণ করা হলো, যারা সত্যের জন্য দাঁড়িয়েছিল—জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে।