ইউরোপ-আমেরিকায় যায় নোয়াখালীর ছানার মিষ্টি

ইউরোপ-আমেরিকায় যায় নোয়াখালীর ছানার মিষ্টি

এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে আশপাশের জেলা, এরপর বিদেশে থাকা এখানকার প্রবাসীদের কাছে খ্যাতি ছড়িয়েছে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়ন বাজারের বিখ্যাত ছানার মিষ্টি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় দেওটির এ সুস্বাদু ছানার মিষ্টি। স্থানীয় ইউনিয়নের নামানুসারে এ মিষ্টি ‘দেওটির মিষ্টি’ নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যানুসারে, প্রায় একশ বছর পূর্বে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নের বটখিল গ্রামের করুণা মন্দার বাড়ির করুণা বাবু মজুমদারের হাতেই এই মিষ্টির যাত্রা শুরু হয়। পাশাপাশি সময়ে শুক দেবনাথ নামের আরেকজনও এই বাজারে মিষ্টি বানানো শুরু করেন।

প্রথম দিকে করুণা বাবু মজুমদার বাড়িতে বসেই মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করতেন। চাহিদা বাড়ার পর দেওটি বাজারে মিষ্টির দোকান খুলে বসেন তিনি। দোকানটির নাম করুণা মজুমদার মিষ্টি ভাণ্ডার।

১৪ বছর আগে করুণা বাবু মারা যান। এরপর মারা যায় তার বড় ছেলে বাবুল চন্দ্র মজুমদার। এখন তাদের দোকান যৌথভাবে পরিচালনা করছেন করুনা বাবুর অন্য চার ছেলে হরিপদ চন্দ্র মজুমদার, দীপক চন্দ্র মজুমদার, পরিমল চন্দ্র মজুমদার ও লিটন চন্দ্র মজুমদার।

করুণা চন্দ্রের নাতি কাঞ্চন মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘আমার দাদার হাত ধরেই এখানকার মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এখন আরও অনেকেই মিষ্টি বানাচ্ছেন। দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মিষ্টি তৈরিতে ব্যয় বেড়েছে। যে কারণে মিষ্টি বিক্রি করে আমাদের এখন তেমন লাভ হচ্ছে না।’

করুণা মজুমদার মিষ্টি ভাণ্ডার ছাড়াও দেওটি বাজারে আরও ৩টি মিষ্টির দোকানে মিষ্টি বেচাকেনা হয়। তারমধ্যে পুরোনো একটি নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এটিও করুণা মজুমদার মিষ্টি ভাণ্ডারের প্রায় সমসাময়িক সময়ে গড়ে ওঠে। শুক দেবনাথ ছিলেন এ দোকানের কর্ণধার। শুক দেবনাথ মারা যাওয়ার পর বর্তমানে তার ছেলে স্বপন দেবনাথ চালাচ্ছেন এ দোকানটি।

বিভিন্ন সময়ে করুণা বাবুর দোকানের কারিগরদের কয়েকজন বের হয়ে যান। তাদের হাত ধরেই ৬-৭ বছর পূর্বে গড়ে ওঠে মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এটিও এখন এই বাজারে অন্যতম জনপ্রিয় একটি মিষ্টির দোকান। একইভাবে তিন বছর আগে গড়ে উঠে বিসমিল্লাহ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। বিসমিল্লাহ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার সাইফুল ইসলামও একসময় করুণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কারিগর হিসেবে কাজ করতেন।

এক দোকানের মিষ্টির সঙ্গে আরেক দোকানের মিষ্টির স্বাদে তেমন কোনো হেরফের নেই। যে কারণে ৪টি দোকানেই এখন সমানতালে বিক্রি হয় দেওটির ছানার মিষ্টি। বিভিন্ন উৎসবের সময় ছানার মিষ্টির জন্য এখানকার দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকে।

দেওটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন শাকিল কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক দূর দূরান্ত থেকে এই মিষ্টি খাওয়ার জন্য মানুষ এখানে আসেন। দেওটির মিষ্টির সঙ্গে এখানকার প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এখানকার মিষ্টি মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছেও পাঠান।

ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দেওটি বাজারে দৈনিক আটশো কেজির মতো মিষ্টি বিক্রি হয়। নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও পাশের জেলাগুলো থেকে এখানে মিষ্টি খেতে দল বেঁধে আসেন তরুণ-যুবকরা। আত্মীয়স্বজনদের হাত ধরে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশির কাছে চলে যায় এখানকার মিষ্টি। বর্তমানে এখানকার প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হয় ২৪০ টাকা করে।

মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ নামের স্থানীয় কাতার প্রবাসী এক যুবক এখানকার মিষ্টির স্বাদ নিতে এসেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমি কাতারে থেকেও এখানকার মিষ্টির সুনাম শুনেছি। আজ খেতে আসলাম। খেয়ে ভালোই লেগেছে। এর আগে আমি এখানে এসেছি। এদের মিষ্টির স্বাদ আগের মতোই আছে।

মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক শহীদ কায়ছার বলেন, উৎসবের সময়ে মোটামুটি বেচাকেনা হয়। অফ সিজনে আমাদের ব্যবসা কম হয়। বর্তমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে গেছে। ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কম টাকায় মিষ্টি বিক্রি করি।

যেভাবে বানানো হয় এই সুস্বাদু ছানার মিষ্টি বিভিন্ন এলাকা থেকে খাঁটি গরুর দুধ সংগ্রহ করে তা পাতিলে গরম করা হয়। তারপর টক ব্যবহার করে দুধ থেকে ছানা আলাদা করা হয়। সম্পূর্ণ পানি মুক্ত করার পর ছানাকে আঠালো করতে এর সাথে অল্প কিছু ময়দা মিশ্রণ করে খামির করা হয়। এরপর সেই খামিরকে গোল করে ছোট ছোট মিষ্টির আকৃতি দেওয়া হয়। এই কাঁচা মিষ্টিকে চিনি মিশ্রিত পানির মধ্যে ডুবিয়ে গরম করে বানানো হয় দেওটির সুস্বাদু ছানার মিষ্টি।