ভোলায় অবাধে জাটকা নিধন, ইলিশের আকালের শংকা

ভোলায় অবাধে জাটকা নিধন, ইলিশের আকালের শংকা

সাব্বির আলম বাবু, বিশেষ প্রতিনিধি: ভোলায় পর্যাপ্ত লোকবল ও অর্থসংকটের কারণে জেলা মৎস্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না। এতে সরকারের জাটকা সংরক্ষণের কার্যক্রম ভেস্তে যাচ্ছে। এবার প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ বেশি ডিম ছেড়েছে। নদীতে জাটকার সংখ্যাও বেশি। কিন্তু জাটকা সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নেই। এতে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পোনাকে একটি বড় ইলিশে পরিণত করতে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও মৎস্য বিভাগের লোকবল ও অর্থসংকটের কারণে তা ভেস্তে যাচ্ছে। এ কারণে ভোলার নদ-নদী ও সাগর মোহনা থেকে জেলেরা অবাধে জাটকা নিধন করছেন। ভোলার কয়েকজন জেলে নেতা বলেন, জাটকা সংরক্ষণের জন্য আট মাস (নভেম্বর-জুন) মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারির নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে নদীতে অভিযান নেই বললেই চলে। ভোলায় অবৈধ জাল দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০০ মেট্রিক টন  জাটকা ধরা পড়ছে। তবে প্রতিদিন জাটকা ধরার পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টন নয় বলে দাবি করেছে মৎস্য বিভাগ। তারা বলছে, প্রতিদিন ২০০ মেট্রিক টন জাটকা ধরা পড়ছে। জাটকা নিধন বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ না নিতে পারার কথা স্বীকার করে মৎস্য বিভাগ বলছে, প্রতিদিন একবার অভিযান চালাতে গেলে ভোলার সাত উপজেলায় কমপক্ষে এক লাখ টাকা দরকার। সেখানে আট মাসেও এক লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া লোকবলসংকটের কারণেও সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। কয়েকজন মৎস্যবিজ্ঞানী বলেন, ইলিশ বেশির ভাগ সময় সাগরে থাকে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সাগরের লোনাপানি থেকে উঠে আসে নদীর মিষ্টি পানিতে। ভোলায় মিষ্টি পানির নদী আছে তিনটি। এগুলো হলো মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও ইলিশা। আরও আছে বিশাল সাগর মোহনা। নদীতে উঠে ইলিশ মিষ্টি পানির গভীরে জন্মানো প্লাংটন খায়। তাই মিষ্টি পানিতে ইলিশের স্বাদ বেশি। গত প্রজনন মৌসুমে(১২ অক্টোবর-২ নভেম্বর) নদীতে উঠে আসা ইলিশের মধ্যে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ মা ইলিশ সফলভাবে ডিম ছেড়েছে। গত ১০ বছরের (২০১৬-২০২৩) মধ্যে এবারই সর্বোচ্চ ডিম ছাড়ার রেকর্ড গড়েছে। ২০১৬ সালে ডিম ছেড়েছে ৪৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০২০ সালে ছেড়েছে ৫১ দশমিক ২ শতাংশ। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র, চাঁদপুরের গবেষণা দল প্রজনন মৌসুমের ২২ দিন, এর আগের ও পরের সময়ে ইলিশের লার্ভা, পোনা ও জাটকার প্রাচুর্যতা পর্যবেক্ষণ করে এমন মন্তব্য করেছেন। দরিদ্র জেলেদের জাল, মাছ জব্দ করে জাটকা ধরা বন্ধ করা যাবে না। 

তবে নদীতে নেমে ভয় দেখালে জেলেরা জাটকা শিকারে নামবেন না বলে মনে করেন ভোলা জেলা ক্ষুদ্র জেলে ও মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম। 

চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ২০২৩ সালে পরিবেশ অনুকূলে থাকায় মা ইলিশ ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ ডিম ছেড়েছে। এর মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ শতাংশ ডিম পোনায় পরিণত হয়, তাহলে আগামী বছর কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি ডিম জাটকায় পরিণত হবে। যদি এই জাটকা টিকে যায়, তাহলে ৪০ হাজার কোটি বড় ইলিশ মাছ হবে। অর্থাৎ শতভাগ জাটকা সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ সম্ভব। তবে শতভাগ না হোক, ৭০-৮০ ভাগ টেকাতে পারলেও আগামী বছর পৌনে ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণ সম্ভব। তবে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু জাটকা (২৫ সেন্টিমিটারের ছোট ইলিশ) যদি  অবৈধ জালে শিকার হয়ে যায়, তাহলে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান আরও বলেন, একটি জাটকা বড় ইলিশ (কমপক্ষে ৫০০ গ্রাম) হতে এক বছরের বেশি সময় (১২-১৬ মাস) নেয়। এ জন্য জেলেকে কমপক্ষে দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। বড় ইলিশ পেতে হলে অবশ্যই অবৈধ জাল ধ্বংস করতে হবে। 

ভোলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, ভোলায় এই অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন। আর দেশে ৬ লাখ মেট্রিক টন। সারা দেশে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। আর ভোলায় গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৩ মেট্রিক টন। ভোলায় গত আড়াই মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ আহরণ হয়েছে। ভোলার ২৫টি মাছঘাটের ১০০ জন জেলে, আড়তদার ও জেলে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলায় যদি প্রতিদিন ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা হয়, তাহলে তার মধ্যে জাটকার পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টনের (৮০ শতাংশ) বেশি। 

তবে জেলা মৎস্য বিভাগ এই তথ্য মানতে নারাজ। সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুস সালেহীন বলেন, প্রতিদিন মোট আহরণের ৪০ শতাংশ (২০০ মেট্রিক টন) জাটকা হতে পারে! 


ভোলা খালের মাথা মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জাটকার মেলা বসেছে। পাইকার মাছ কিনে বরফ দিয়ে বাক্সে ঢোকাচ্ছে। এক পাইকারের বাক্সে দেখা যায়, নানা প্রজাতির মাছের পোনা ও জাটকা। মাছগুলো এত ছোট যে এক কেজিতে শতাধিক মাছ হবে। এক কেজি মাছের খুচরা দাম ৩০০ টাকা। ঘাটে প্রবেশ পথের ডান পাশে আরেকটি বাক্সের ওপর বসানো টিনের থালায় আরও ছোট ছোট মাছের পোনা, ইলিশের জাটকা দেখা যায়। এ জাটকা সাধারণত অবৈধ পাই ও বেহুন্দি জাল দিয়ে ধরা হচ্ছে।


ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের মাঝিরহাট মাছঘাটে গিয়ে চোখে পড়ে একই দৃশ্য। এ ঘাটের জেলে মো. জসিম উদ্দিন মাঝি ১৭ হালি (চারটিতে এক হালি) জাটকা, সাড়ে সাত হালি টোল্লা (জাটকা থেকে একটু বড়) আর এক হালি মাঝারি আকারের ইলিশ পেয়েছেন। জাটকার হালি ১৮০ টাকা, টোল্লার হালি ৫৬০ টাকা ও মাঝারির হালি ২ হাজার ৪৫০ টাকা দাম উঠেছে। সব মিলিয়ে দাম উঠেছে ৮ হাজার ৭৬০ টাকা। আড়তদার মো. কবির হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘এ মাছ বড় হলে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। কিন্তু আমরা দাদন দিয়ে ঠেকেছি। তা–ই জেলেরা যা ধরে আনেন, তাই ডাক ওঠাই।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা মৎস্য কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ভোলায় বিশাল জলরাশির জাটকা সংরক্ষণে যে লোকবল দরকার, তা মৎস্য বিভাগের নেই। জেলা-উপজেলা কার্যালয়ে ৬০টি পদ থাকলেও ১৮ জনকে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কার্যক্রম। এখানে কয়েক উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি অভিযান দল গঠন করা দরকার। কর্মকর্তারা আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলায় একটি স্পিডবোট ও একটি দ্রুতগামী ট্রলার দরকার। কিন্তু পুরো জেলায় আছে দুটি স্পিডবোট। তা–ও তেলের সংকট। জেলে-আড়তদারের নিকট ট্রলার ধার নিয়ে অভিযান চালাতে গেলে শতভাগ সফল হওয়া যায় না। টানা আট মাস অভিযান চালাতে বললেও বরাদ্দ নেই বললেই চলে। জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, সাত উপজেলায় প্রতিদিন একবার অভিযান চালাতে গেলে কমপক্ষে এক লাখ টাকা দরকার, সেখানে গত আড়াই মাস চলে গেলেও কোনো বরাদ্দ আসেনি। ভোলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জানুয়ারি মাসের প্রথম কিস্তিতে সাত উপজেলায় ৪৩টি অভিযান চালিয়ে ৪ জনের জরিমানাসহ ১ লাখ ৬৭ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ও ৪১৩টি নানা রকম অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। মাছগুলো এতিমখানায় বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি শুরু হয়েছে ২৩ জানুয়ারি। 

ভোলা জেলা ক্ষুদ্র জেলে ও মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র জেলেদের জাল, মাছ জব্দ করে জাটকা ধরা বন্ধ করা যাবে না। নদীতে নেমে ভয় দেখালে জেলেরা জাটকা শিকারে নামবেন না। ভোলা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ লোকবল ও নৌযান সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, জাটকা ধরা পড়ছে, তবে সব জাটকা নয়। জাটকা সংরক্ষণে সবার এগিয়ে আসা উচিত।