ছয় বছর ও ৮০ কোটি টাকা খরচের পর বাতিল হচ্ছে মিল্ক ভিটার প্রকল্প
মিল্ক ভিটার ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং লাভ বাড়ানোর লক্ষ্যে ৩৮৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে ৬ বছর ধরে, খরচও হয়েছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন প্রকল্পটির কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম প্রকল্পটি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ফরিদপুরের চরাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় গাবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও দুগ্ধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে দুগ্ধ কারখানা স্থাপন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের মালিকানাধীন দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য কোম্পানি মিল্ক ভিটা।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) তেজগাঁওয়ে মিল্ক ভিটা আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ২০১৫ সাল থেকে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করা শেখ নাদির হোসেন লিপু মন্ত্রীকে জানান, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।
নাদির হোসেন বলেন, 'এখন দেখা যাচ্ছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে কারখানা স্থাপন করা হলে এর কাঁচামালের ব্যাপক সংকট হবে। আবার অন্য অঞ্চল থেকে কাঁচামাল এনে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করা হলেও তা বিক্রির যথেষ্ট বাজার এই অঞ্চলে নেই। পরবর্তীতে কারখানাটিকে অব্যবহৃত হিসেবে ফেলে রাখতে হবে।'
তখন মন্ত্রী তাজুল বলেন, 'পরিস্থিতি এরকম হলে প্রকল্পটি বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে যদি সুযোগ থাকে, অন্য এলাকায় এই কারখানা স্থানান্তর করা যায় কি না, সেটাও দেখতে হবে।'
আরও দুটি প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়েও চিন্তিত মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ। এই তিনটি প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫৪০ কোটি টাকা। এখন মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ মনে করছে, কোনো প্রকল্প থেকে তারা কোনো রাজস্ব আয় করতে পারবে না।
তাজুল ইসলাম প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে লিপু বলেন, 'প্রকল্প গ্রহণের সময়কার কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতনদের চাপে কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল।'
মিল্ক ভিটার তথ্য অনুসারে, কৃষক পর্যায়ে ঋণ বিতরণ, প্রকল্পের আওতায় গাড়ি কেনা ও জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত বেশ কিছু কাজে ব্যয় করা হয়েছে ৭৮.৭৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। তিন বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এর বাস্তবায়নকাল ধরা হয়। প্রকল্পে একটি দুধ প্রসেসিং ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত কারখানা, জমি অধিগ্রহণ, অফিসার্স ও স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ, দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র ও মিনি ডেইরি প্ল্যান্ট স্থাপন, ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্ট তৈরিসহ বিভিন্ন কাজ করার কথা ছিল। একইসঙ্গে ২০২২ সালে একটি আইসক্রিম কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যেও একবার প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল।
এই প্রকল্পের সঙ্গে মিল্ক ভিটার আরও দুটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর একটি দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুগ্ধ কারখানা স্থাপন। ২০১৭ সাল থেকে চলা এই প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৭.৯৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ—মাস দুয়েকের মধ্যেই এটি উৎপাদনে যাবে।
কিন্তু মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান এখন বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, 'উত্তরাঞ্চলে যেখানে দুধের দাম ৫০ টাকা, সেখানে চট্টগ্রামে ১০০ টাকার বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। এত দামে কাঁচামাল কিনে লাভ করা সম্ভব নয়। এ কারণে এই কারখানাটি মিল্কভিটার কোনো কাজে আসবে না।'
এ কারখানার যন্ত্রপাতিগুলো অন্য কারখানায় স্থানান্তর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির গুঁড়া দুধের কারখানা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন চেয়ারম্যান। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে এ প্রকল্প থেকে লাভ করা শঙ্কিত কর্তৃপক্ষ। এজন্য তিনি চান আমদানি করা গুঁড়া দুধের ওপর যেন শুল্ক বাড়ানো হয়।
এ সময় মন্ত্রী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন, প্রতিটি কারখানা এবং প্রতিটি প্রকল্পের বাস্তব চিত্র আলাদা আলাদাভাবে অনুসন্ধান করে যেন মন্ত্রণালয়ে তুলে ধরা হয়।
লাভজনক মিল্ক ভিটা যেভাবে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হলো
মিল্ক ভিটার আর্থিক বিবরণী অনুসারে, এক দশকের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথমবারে মতো লোকসান করেছে কোম্পানিটি। ওই বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৪.৩৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এ সময়ে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ৩৪৯ কোটি টাকা এবং মোট ব্যয় করতে হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা।
যদিও মন্ত্রী প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক কি না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সব কর্মকর্তারাই এটিকে লাভজনক হিসেবে সায় দেন।
বর্তমানে সারা দেশে মিল্ক ভিটার পাঁচটি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বর্তমানে চালু রয়েছে, দুটি দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ। বন্ধ কারখানাগুলোর ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে চলমান কারখানাগুলোর আয় থেকে। প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়লেও ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির আয় কমে আসছে এবং এটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে।
বন্ধ থাকা কারখানাগুলোকে লাভজনক করতে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই শেষপর্যন্ত এখানে বিনিয়োগে রাজি হয়নি।
মিল্ক ভিটার বিভিন্ন সূত্র বলছে, মিল্ক ভিটার দুগ্ধজাত পণ্যের বিক্রি বাড়লেও প্রতিষ্ঠানটির প্রক্রিয়াজাত দুধের বিক্রি কমেছে। পাঁচ বছর আগে মিল্ক ভিটা প্রতিদিন ১.৮০–১.৮০ লাখ লিটার তরল দুধ বিক্রি করত, এখন সেটা নেমে এসেছে ৭০–৮০ হাজার লিটারে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মিল্ক ভিটা ৬.৭৬ কোটি লিটার দুধ সংগ্রহ করেছিল, যা ২০২২-২৩ সালে মাত্র ৩.৭৮ কোটি লিটারে নেমে আসে।
প্রতিষ্ঠানটি দুধ, কেক, পেস্ট্রি, ননীযুক্ত গুঁড়া দুধ, সন্দেশ, আইসক্রিম, রসগোল্লা, মিষ্টি, দই, মাঠা, চকলেট মিল্কসহ নানা পণ্য বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রীত পণ্যের মধ্যে ৫৪ শতাংশ হলো তরল দুধ।
বিক্রি কমে আসার প্রধান কারণ হিসেবে মিল্ক ভিটার কর্মকর্তারা জানান, তাদের কোনো বিশেষজ্ঞ মার্কেটিং টিম নেই। সে কারণে বাজার সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। মার্কেটিং টিম না থাকার কারণে মিল্ক ভিটা মানসম্পন্ন পণ্য এবং ব্র্যান্ড ইমেজের সুবিধা নিয়েও বাজারে টিকতে পারছে না।
তিনবার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেসরকারি খাতে মার্কেটিং ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও তা সফল হয়নি।
মন্ত্রী তাজুল ইসলাম কর্মকর্তাদের দ্রুত একটি কমিটি গঠন করে বিষয়গুলো যাচাই করা এবং কারখানাগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে একজন পরামর্শদাতা নিয়োগেরও পরামর্শ দেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকের উৎপাদিত দুধের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং ভোক্তাশ্রেণির মধ্যে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত দুগ্ধ সরবরাহের জন্য দুগ্ধশিল্প গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানটির ছিল. তা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে তারা। দেশব্যাপী চাহিদা যত বাড়ছে, প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতাও ধীরে ধীরে কমে আসছে।