গায়েবি ধর্ষণ মামলায় ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীর হাজতবাস!
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ৫ শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ষষ্ঠ শ্রেণীর এক শিশু শিক্ষার্থীকে হাজতবাস করানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিশুটিকে সাতদিন কারাভোগের পর জামিন দিয়েছে আদালত। তবে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া শিশুটি ভয়ে এখন স্কুলেও যেতে চাচ্ছে না।
পুলিশ আতঙ্কে ভুগছে ভুক্তভোগী ঔ শিশু।
গাজীপুর কিশোর সংশোধনাগারে কারাবাস করে আদা শিশু সাকিবুল ব্রাহ্মনবাড়িয়া সদর ইউনিয়নের টেকানগর গ্রামের উসমান মিয়ার ছেলে।
এদিকে শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টা মামলার ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভয়ে সাকিবুলের সহপাঠী এবং অন্য শিশুরাও এখন স্কুলে যেতে চাচ্ছে না। সাকিবুল উপজেলা সদরের টেকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।
এলাকাবাসী জানান, গত ৪ জুলাই নাসিরনগর থানায় ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ভুক্তভোগী এক শিশুর পিতা মো. জালাল উদ্দিনকে বাদী করে নাসিরনগর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করে নাসিরনগর থানা পুলিশ। যদিও বাদীর দাবি পুলিশ তাকে থানায় ডেকে এনে বলেছে মামলার বাদী হতে হবে।
এবিষয়ে মামলার বাদী মো. জালাল উদ্দিন বলেন, 'আমাকে ডেকে এনে থানার এসআই এনামুল হক বলছে তুমি মামলার বাদী হইবা। পরে আমারে বসাইয়া রাইখা মামলা লেইখা এরা আমার সই নিছে। আমার মেয়ে ছোট, নদীতে দল বেধে খেলাধুলা করে, গোছল করে। সময়ে কাপড় পড়ে আবার সময়ে কাপড় ছাড়াই গোছল করে।'
মামলার আসামী ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিবুল মিয়া জানায়, 'আমি সকাল সাতটার সময় আমার সহপাঠীর সাথে প্রাইভেট পড়তে নাসিরনগর যাই। সকালের প্রাইভেট শেষে স্কুলে যাই দশটার সময়। তখন আমাদের পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা শেষে বিকাল চারটার দিকে অন্য আরেকটা প্রাইভেটে যাই। সেখান থেকে আমার বাবা আমাকে থানায় নিয়ে আসে। আমি কিছুই জানিনা অথচ থানায় নেওয়ার পর পুলিশ আমাকে জেলে দিয়ে দিল।'
সাকিব আরো জানান, 'আমি অসুস্থ্য, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। জেলে থাকতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমার গ্রামের স্কুলের ম্যাডামরা আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। পুলিশ দেখলে ভয় লাগে আবার যদি ধরে নিয়ে যায়।'
মামলার স্বাক্ষী ও টেকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রওশন আরা বলেন, 'ঘটনার দিন ছিল বন্ধের পর স্কুল খোলার প্রথম দিন। সকাল ৯টার সময় স্কুলে ঢুকে ৫জন মেয়ে বাচ্চাকে শ্রেণিকক্ষের ভিতরে দেখতে পায় আমার সহকারি শিক্ষক সালমা আক্তার। এদের কয়েকজনের পরনে পোশাক ছিল না। কিন্তু কোনো ছেলেকে আমরা আশেপাশে দেখিনি।'
তিনি আরো জানান, 'সাকিব আমার সাবেক ছাত্র। সে অনেক ভালো ছেলে।'
মামলার আরেক স্বাক্ষী সালমা আক্তার জানান, 'আমিই প্রথম বাচ্চাগুলোকে দেখতে পেয়ে ম্যাডামকে জানাই। আমরা সাকিব তো দুরের কথা, কোনো ছেলেকেই দেখি নাই।'
এদিকে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে ৪ জুলাই সকাল সাড়ে আটটার সময় জাম্বুরার প্রলোভন দেখিয়ে শিশুদের স্কুলে নিয়ে যায় সাকিব। অথচ প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সেদিন প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে ৪৫ মিনিটের দূরত্বে সকাল সাতটার সময় সহপাঠীর সাথে সাকিব নাসিরনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
এ বিষয়ে সাকিবের শিক্ষক ও নাসিরনগর আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো. রওশন সিদ্দিক জানান, 'সাকিব আমার ছাত্র। গত ৪ জুলাই সকাল আটটায় আমার কাছে গণিত প্রাইভেট পড়তে আসে সাকিব। তার বাড়ি থেকে আমার এখানে আসতে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় লাগে।'
টেকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর মা ফাহিমা বেগম বলেন, 'আমার ছেলে স্কুলে যেতে চাচ্ছে না, বলে স্কুলে গেলে যদি পুলিশে ধরে নিয়ে যায়।'
ভুক্তভোগী পাঁচ শিশুর একজনের মা বলেন, 'ঘটনার দিন আমি দেখেছি আমাদের পাঁচজন বাচ্চা কাপড় ছাড়া নদীতে নেমে গোছল করতেছে। কতক্ষণ পরে দেখছি স্কুলের সিঁড়ি দিয়া উপড়ে গেছে। আমি আমার বাচ্চারে ডাক দিছি নিচে নামার জন্য।'
তিনি আরো বলেন, 'আমার মেয়ের বয়স পাঁচ বছর। সে এখনও বিছিনায় প্রস্রাব করে, কাপড় ছাড়া নদীতে গোছল করে। ওসমানের পোলারে আমরা চিনি, হে ইতা করার পোলা না, বয়সও হয়নাই। '
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহাগ রানা বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাকিবকে আটক করা হয়েছিল। মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। পুলিশ আতঙ্কের বিষয়টি সত্য নয়।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার শাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, 'এরকম হওয়ার কথা না, আমার নজরে এসেছে এখন আমি দেখব।'
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মর্নিং নিউজ কথা বলে ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি ভুল বুঝাবুঝি ছিল এবং আদালতে তোলার দিনই শিশুটির জামিন হয়। তাহলে এত ছোট বাচ্চার জেল খাটার দায় কে নেবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি এবং একদিন সংশ্লিষ্ট আদালত বন্ধ থাকায় এমনটি ঘটেছে।