গল্পটা বলেই ফেললাম স্যার

গল্পটা বলেই ফেললাম স্যার

২২ সেপ্টেম্বর, রবিবার: আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে।আমি তখন চট্টগ্রামে কর্মরত। ইয়াহিয়া স্যার আমার অফিসে হন্তদন্ত হয়ে আসলেন।একটি ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন: 

"এই নাও আমার সকল আর্থিক লেনদেনের কাগজ। আমি করের হিসাব বুঝি না। একজন প্রতি বছর আমার রিটার্ন প্রস্তুত করে আমাকে দিয়ে সই করিয়ে নেয়।সব ঠিক আছে কিনা তুমি দেখে দাও।"

আমি স্যারের সব কাগজ পরীক্ষা করলাম। বহু পুরনো একটি কাগজ আমার নজরে পড়লো।জিজ্ঞেস করলাম, কাগজটির হালনাগাদ কোন কপি আছে কিনা। জবাবে স্যার জানালেন ,"নেই"। তিনি বললেন, "খুলনা থেকে হালনাগাদ কপি সংগ্রহ করে আমি আবার আসবো।"  এত পুরোনা হিসাব বের করতে অনেক কষ্ট হবে বললেও স্যার জানালেন যে, তিনি চেষ্টা করে দেখবেন। কয়েকদিন পর স্যার সে কাগজ নিয়ে আসলেন।এ কাগজ সংগ্রহে স্যারের অনেক কষ্টের কথাও বললেন। আমাকে বললেন ,"এবার দেখো সব ঠিক আছে কিনা"। আমি পরীক্ষা করে দেখলাম, অনেকদিন থেকে একটু একটু করে কম পরিমাণে কর দেয়া হয়েছে। আজ সে অংকের পরিমান কেবল চাকরির বেতনের উপর নির্ভরশীল একজন শিক্ষকের জন্য অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।আনুমানিক অংকটা কত হতে পারে তাও জানালাম। স্যারের চোখেমুখে উদ্বেগের চাপ লক্ষ্য করলাম।এখন কি করণীয় তা তিনি জানতে চাইলেন। 

আমি দুটি অপশনের কথা বললাম।

প্রথমে জানালাম "ঝামেলা মুক্ত থাকতে চাইলে এত জটিল ও পুরনো হিসাব না টেনে আগের মত করেই কর দিয়ে যেতে পারেন।" আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই স্যার নিজেই বলে উঠলেন ,"এটাতো অনৈতিক হবে"। জবাবে আমিও সম্মতিসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম।দ্বিতীয় অপশনটি যে সমুদয় করা পরিশোধ করা তা আর বিস্তারিত বলতে হলো না। আমি স্যারকে সময় নিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পরামর্শ দিলাম। আমারও ইচ্ছে ছিলো স্যার যেনো ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিন।

স্যার বেশীদিন অপেক্ষা না করে একদিন পরেই আমার অফিসে আসলেন। সামনের চেয়ারে বসে ধীর কণ্ঠে বললেন, "কেউ জানুক বা না জানুক আমিতো আজ জেনেছি, সরকার আমার কাছে করের টাকা পাবে। আমার কষ্ট হলেও সরকারের এই পাওনা আমাকে পরিশোধ করতেই হবে। এর অন্যথা হলে কেউ টের পাক বা না পাক আমিতো টের পাবো আমার সকল অর্জন ছিলো মিথ্যা; তোমাদেরকে যে শিক্ষা দিয়েছি অথবা যত ভালো ভালো কথা বলেছি সে সব কিছুই ছিলো প্রহসন।" তারপর অনেকটা দৃঢ় কণ্ঠেই বলে উঠলেন, "আর সময় নেয়ার প্রয়োজন নেই; তুমি হিসেব করে আমাকে জানাও ঠিক কত টাকা দিতে হবে ।"

আমার পিছনের জানালা দিয়ে আসা শেষ বিকেলের আলোটা তখন ফিকে হয়ে আসছিলো। 

স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও দাঁড়ালাম। আমাকে উইশ করে স্যার দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি হঠাৎ অনুভব করলাম, বিকেলের ফিকে আলোকে দুরে ঠেলে দিয়ে একটি জীবন্ত প্রদীপ আলো ছড়াতে ছড়াতে চলে গেলো।কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। ততক্ষণে হালকা পাতলা গড়নের এ শিক্ষাগুরু আমার কাছে হিমালয় হয়ে উঠলেন। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে স্যারের সাফল্য কামনা করছি।


(লেখক- ইকবাল, সদস্য , এনবিআর। ২০ তম ব্যাচ  চ.বি)