১১ বছর পর বেরোবি শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে সন্দেহ ইউজিসির
বেরোবি প্রতিনিধি: এগার বছর ধরে চাকরি করে আসা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশন পত্র দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। ওই শিক্ষক হলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধান। তিনি প্রভাষক হিসেবে ২০১২ সালে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে দুই দফায় পদোন্নতি নিয়ে বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। তার পদোন্নতিতেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। এইসব বিষয়ে নিয়োগ বঞ্চিত শিক্ষক মাহমুদুল হকের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি এই পত্র দিয়েছে।
গত ৮ জানুয়ারি ইউজিসির উপ-সচিব মোঃ গোলাম দস্তগীর স্বাক্ষরিত এক পত্রে অভিযোগের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণাদিসহ দফাওয়ারী লিখিত বক্তব্য ও উক্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতে রীট পিটিশনের বিপরীতে উচ্চ আদালতের জারিকৃত রুল ও আদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহীত পদক্ষেপের হালনাগাদ তথ্য সাত কর্ম দিবসের মধ্যে প্রেরণ করতে বলা হয়। রবিবার (১৪ জানুয়ারি) চিঠিটি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ইউজিসিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের পাঠানো চিঠি মারফত জানা যায়, ২০১২ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক পদে তাবিউর রহমান প্রধানের ‘অবৈধ’ নিয়োগের কারণে নিয়োগ বঞ্চিত হন মাহামুদুল হক। ২০১৯ সালে সাত বছর আইনি লড়াইয়ের পর হাইকোর্টের রায়ে প্রভাষক পদে মাহামুদুল হক নিয়োগ পান। কিন্তু তিনি ওই রায় অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় ২০২২ সালে আবার তিনি হাইকোর্টে রিট মামলা করেন।
মাহামুদুল হকের রীটের প্রেক্ষিতে ১৪ মার্চ ২০২২ হাইকোর্ট জালিয়াতির কারণে কেন তাবিউর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন। অন্যদিকে ২০১৩ সালের হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী কেন মাহামুদুল হককে ২০১২ সালের বাছাইবোর্র্ডের সুপারিশ অনুযায়ী নিয়োগ কার্যকর করে তাকে জ্যেষ্ঠতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা (বেতন-ভাতা) দেওয়া হবে না তাও ওই রুলে জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।এরপর হাইকোর্টের আগের রায় ও চলমান রুল অনুযায়ী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত ও তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুদক ও ইউজিসিতে পাঠানো এক চিঠিতে অনুরোধ করেন মাহমুদুল হক। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক ইউজিসির নিকট এ ব্যাপারে জানতে চায়। দুদকের চিঠির প্রেক্ষিতে বেরোবি কর্তৃপক্ষকে ইউজিসি চিঠি পাঠিয়েছে।
তবিউর রহমান ও মাহামুদুল হকের নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজ-পত্র ও মাহামুদুল হকের অভিযোগ পত্র থেকে জানা যায়, নিয়োগ বাছাইবোর্ডের সুপারিশপত্র ‘জালিয়াতি করে’২০১২ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে ১১ বছর ধরে চাকরি করে যাচ্ছেন তাবিউর রহমান প্রধান। বর্তমানে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন। হয়েছেন বেশ কয়েকবার শিক্ষক সমিতির নেতা। শুধু তাই নয়, সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার প্রক্রিয়াতেও রয়েছে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ। নিয়োগ জালিয়াতির জন্য তার বিরেুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চান হাইকোর্ট। কিন্তু তৎকালীন প্রশাসনের উদাসীনতায় কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন গুরুতর অভিযোগের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র অনুসন্ধান করে আরো জানা যায়, ২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের জন্য অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক (স্থায়ী) পদে একটি এবং সহকারি অধ্যাপক/প্রভাষক দুটি স্থায়ী পদে বিজ্ঞাপন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে তাবিউর রহমান প্রধানসহ মোট ২২ জন প্রভাষক পদে দরখাস্ত করেন। পরের বছরের ১৩ জানুয়ারি প্রভাষক পদের জন্য বাছাই বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। বাছাই বোর্ড যথাক্রমে মোহা. মাহামুদুল হক ও নিয়ামুন নাহারকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রেখে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু বাছাই বোর্ডের সুপারিশপত্রে দেখা যায়, ‘জালিয়াতি’করে অপেক্ষামাণ তালিকায় তৃতীয় হিসেবে তাবিউর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বাছাইবোর্ডের পর।
বাছাইবোর্ডের সুপারিশপত্রে দেখা যায়, কম্পিউটারে কম্পোজকৃত ‘মেধাক্রমানুসারে’ শব্দটি কলম দিয়ে কেটে ‘যেকোন’ শব্দটি লেখা হয়েছে সুপারিশপত্রে। ওই সুপারিশপত্রে বলা হয়েছে: “চূড়ান্তভাবে মনোনয়নপ্রাপ্ত আবেদনকারী ওই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করতে অপারগ হলে অপেক্ষামান তালিকা থেকে প্রথমজনকে নিয়োগ করার সুপারিশ করা হলো। অপেক্ষামান তালিকার প্রথম জন যোগদানে অপারগ হলে অপেক্ষমান তালিকার দ্বিতীয় জনকে নিয়োগ করার জন্য সুপারিশ করা হল।” অপেক্ষামান তালিকার তৃতীয়জন সর্ম্পকে কিছুই বলা নেই কারণ ওই সিরিয়ালই ছিল না এজন্য যে দু’টি পদের বিপরীতে দুজনকে অপেক্ষামান তালিকায় রাখা হয়েছিল।
এরপর ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ২১তম সিন্ডিকেট অপেক্ষামান তালিকায় দুইজনের পরিবর্তে তৃতীয়জন তাবিউর রহমানের নাম অনুমোদন করা হয় এবং বলা হয় নিচের তালিকা থেকে “যে কাউকে” নিয়োগ দেওয়া যাবে। সিরিয়াল রাখা হয় ১. মোহা. মাহামুদুল হক ২. নিয়ামুন নাহার ৩. তাবিউর রহমান প্রধান। এতে মেধাতালিকার প্রথমজন যোগদান না করায় তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। উল্লেখ্য যে, অপেক্ষামান তালিকায় দুইজনের পরিবর্তে ‘জালিয়াতি’ করে তাবিউরের নাম অর্র্র্ন্তভুক্ত করা হয় ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন দেওয়া হয়।
একই সিন্ডিকেটে (২১তম) অনুমোদনপ্রাপ্ত “যে কাউকে” শব্দটি ২২তম সিন্ডিকেটে সিন্ডিকেট সদস্যদের আপত্তির কারণে বাতিল করা হয়। অর্থাৎ অপেক্ষামান তালিকার প্রথমজন মোহা. মাহামুদুল হক এবং দ্বিতীয়জন নিয়ামুন নাহার নিয়োগ পান সুপারিশ ও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। ২২তম সিন্ডিকেটেও জালিয়াতি করা হয়। ‘যেকাউকে’ শব্দটি বাতিল করা হয় বটে কিন্তু অপেক্ষমান তালিকায় সিরিয়াল পরিবর্তন করা হয়। এতে নিয়োগের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত ২জন শিক্ষকদের নাম লেখার সময় প্রথমজন হিসেবে তাবিউর রহমান প্রধান এবং দ্বিতীয়জন হিসেবে নিয়ামুন নাহার-এর নাম লেখা হয়। অপেক্ষমান তালিকায় প্রথম মোহা. মাহামুদুল হকের নাম বাদ দিয়ে অপেক্ষমান তালিকার সিরিয়াল পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া তাবিউর রহমান প্রধানকে অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ নিয়োগ বাছাইবোর্ড ছিল প্রভাষক পদে। অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কেউ দরখাস্ত না করায় অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদের কোন বাছাইবোর্ড হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদে প্রার্থী পাওয়া না গেলে এর বিপরীতে প্রভাষক নিয়োগ দিতে হলে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে হয় কিন্তু তাবিউর রহমানের নিয়োগের সময় এই নিয়মও অনুসরণ করা হয়নি।
এদিকে তাবিউর রহমান সহকারি অধ্যাপক/প্রভাষক পদের বিপরীতে দরখাস্ত করলেও ২৫ ফেব্রুয়ারি ২২তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অধ্যাপক/সহযোাগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে অস্থায়ীভাবে প্রভাষক পদে ‘অবৈধভাবে’ নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে যোগদান করেন।
ওই বিভাগের শিক্ষক মাহামুদুল হক বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট, দুদক, ইউজিসিসহ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের রায় ও চিঠি প্রমাণ করে যে ২০১২ সাল থেকে আমার জৈষ্ঠ্যতা ও বেতন-ভাতা প্রদান করে তাবিউর রহমানকে দ্রুত বরখাস্ত করা এবং তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা দায়ের করা একমাত্র আইনগত সমাধান। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বেশকিছু অইনগত জটিলতার সমাধান করেছেন। আশা করছি আমার এ দীর্ঘ সময়ের বঞ্চনারও সমাধান করবে।
এ ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও রিসিভ করেনি, পরবর্তীতে কল ব্যাক করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘উপাচার্য মহোদয় ইউজিসির মিটিং-এ ঢাকায় রয়েছেন। ওনি আসলে অনুমোদন নিয়ে জবাব প্রদান করা হবে।’