ফেনীতে শুক্রবার স্ট্রাইক ফর ওয়াটার জাস্টিস কর্মসূচি ঘোষণা
ফেনী: ভয়াবহ এক বন্যায় ডুবেছে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ আশপাশের জনপদ। সরকারি হিসেবে শুধু ফেনীতেই বন্যায় মারা গেছেন ২৩ জন মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়েছে হাজার হাজার ফেনীবাসী। এই বন্যায় স্বল্পমেয়াদী অনেক ক্ষতির পাশাপাশি বেশ কিছু বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে ফেনী। পানির চাপ সইতে না পেরে সোনাগাজীতে ছোট ফেনী নদীতে অবস্থিত মুছাপুর ক্লোজারটি ভেঙে গেছে। ফলে সমুদ্রের লবনাক্ত পানি ঢুকতে শুরু করেছে জনপদে। ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে ছোট ফেনী নদীতে।
এমন পরিস্থিতিতে ফেনীর পুনর্বাসন, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে করণীয় নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছে জেলার নাগরিক সমাজ। এই মতবিনিময় সভায় জেলার পরিবেশবিদ, সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও তরুণ সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সন্ধ্যায় ফেনী প্রেসক্লাবে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা থেকে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘আমরা ফেনীবাসী’ এর ব্যানারে ফেনী শহিদ মিনারে স্ট্রাইক ফর ওয়াটার জাস্টিস কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
সভার শুরুতে সময় টিভি ও বাংলাভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে পরশুরাম সীমান্তের মুহুরির চরে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক জোরপূর্বক বাঁধ কেটে ফেনীতে পানি ঢুকিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এই সময় উপস্থিত সবাই ফেনীর বন্যার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেন। শুধু এই দফা নয়, সারা বছর ফেনী নদী থেকে ভারত পানি তুলে নেয় এবং বন্যা এলে পানি ছেড়ে দেয়, যাকে পানি সন্ত্রাস দাবি করে সারাদেশের সকল নদীতে পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ফেনী থেকে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফেনীর নাগরিক সমাজ।
এছাড়া মুছাপুর ক্লোজার পুননির্মাণ, ভারতের কেটে দেওয়া বাঁধ পুননির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাবসায়ীদের প্রনোদানা প্রদানসহ স্থানীয় নানান সমস্যা ও আন্তসীমান্তীয় বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিষয়ে দাবি নিয়ে সরকার প্রধানসহ সরকারের উপদেষ্টাদের সাথে জেলার নাগরিক সমাজের স্বাক্ষাৎ করাসহ জেলার বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজের সিদ্ধান্ত হয়। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতাও কামনা করা হয়।
মতবিনিময় সভার সমাপনীতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বন্যা শুরুর সাথে সাথে দেশের কয়েকজন সিনিয়র গবেষক বলে দিয়েছেন এই বন্যার পেছনে উজানের দেশ ভারতের কোনো দায় নেই। যদিও আমরা এখন গণামধ্যমের রিপোর্টেও দেখছি তারা বাঁধ কেটে আমাদের ডুবিয়েছে। ভারত যদি বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়ে বাঁধ কেটে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে থাকে তাহলেও আমরা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। আর যদি তাদের দাবি অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারী বৃষ্টিতে এটা হয়েছে তাহলেও দূষণকারী রাষ্ট্রগুলোর কাছে আমরা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। তাই আমাদেরকে এ নিয়ে দাবি তুলতে হবে। ক্ষতিগুলো তুলে ধরতে হবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন বা উজানের বাঁধ ছেড়ে দেওয়ার কারণে আমরা পানিতে ডুবলেও এই পানি দীর্ঘ সময় আটকে থাকার পেছনে আমাদেরও দায় ছিল। কারণ আমরা নদীকে ছোট করে দিয়েছি। এলজিআরডি প্রতিটি ব্রিজের কাছে নদীকে ন্যারো করে দিয়েছে। যার কারণে ব্রিজের কাছে এসে পানি সরতে পারছে না। এটাও বন্যাকে ভয়াবহ করেছে। এগুলো নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। দখলকৃত সকল জলাভূমি উদ্ধারে জোর দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশেও কাপ্তাইতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ আছে। সেখানেও পানি বেড়ে গেলে ছাড়া হয়। তবে আগ থেকে ঘোষণা দিয়ে জোয়ার ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাড়া হয়, যেন মানুষের ক্ষতি না হয়। কিন্তু ভারত কখনোই সেটা করেনি। তাদের পানি বেড়ে গেলেও আমাদের জানায় না। ছাড়তে গেলেও জানায় না। তারা আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ও না। আমরা মনে করি নদী জীবন্ত সত্ত্বা। নদীতে কোনো বাঁধ থাকতে পারে না। তাই এখন থেকে আমাদের আন্দোলন হবে সব ড্যাম ভেঙে দেওয়ার দাবিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে এই আন্দোলন আমরা ফেনী থেকে শুরু করছি। তারপর সারাদেশ করবে, আশা করি বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের সাথে একমত হবে। কারণ উজানের এমন ড্যামের কারণে আরও অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত।
ফেনী সাংবাদিক ফোরাম ঢাকার কোষাধ্যক্ষ বুরহান উদ্দিন ফয়সলের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন, দৈনিক ফেনীর সম্পাদক আরিফ রিজভী, সময় টিভির সিনিয়র রিপোর্টার আতিয়ার সজল, সমাজকর্মী ও ক্রিড়া সংগঠক শরিফুল অপু, ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী আব্দুল্লাহ হাসান, পরিবেশ ও জলবায়ু সাংবাদিক কেফায়েত শাকিল, প্রবীন সাংবাদিক কামাল উদ্দিন ভুইয়া, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ফেনী কমিটির সদস্য সাংবাদিক সোলায়মান হাজারী ডালিম ও ইঞ্জিনিয়ার শওকত, সাংবাদিক জহিরুল হক মিলু, ইউসুফ আলী ও মেহরাব মেহেদী, ইউথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের ইভেন্ট ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার এস জে অপু, ইউথনেট গ্লোবাল টিমের পরিবেশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ সময়ন্বয়ক মোহাইমিনুল ইসলাম জিপাত প্রমুখ।