জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও আমাদের ভাবনা
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও আমাদের ভাবনা
ড. মোঃ শহীদুল হক:
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। কোন জাতি যদি আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, তখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এর সুফল ভোগ করতে থাকে। আর শিক্ষা ক্ষেত্রে যখন অশ্লীলতা, অনৈতিকতাসহ নানা রকম নৈরাজ্য বিরাজ করে, তখন এর কুফল ভোগ করতে হয় পুরো জাতিকে। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ নিয়ে যথাযথ পর্যালোচনা করা এবং এর অসংগতিগুলো দূর করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো অতি জরুরি। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সাজানো শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকগুলো সমস্যার মাঝে নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরা হলো:
মাদ্রাসা শিক্ষা
নতুন শিক্ষাক্রম এবং আরো কিছু আইন ও নিয়মের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা। এতে মাদ্রাসা শিক্ষার মৌলিক আদর্শ পরিপন্থী অনেক বিষয় প্রবেশ করেছে। ধর্মীয় বিষয়গুলো ছাড়া সাধারণ বিষয়গুলোতে হুবহু স্কুলের বই দেয়া হয়েছে। কিছু বইয়ের প্রচ্ছদে দেয়া হয়েছে এমন কিছু ছবি যা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। আর সেসব বইয়ের মাঝে এমন কিছু উপাদান ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যা শুধু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণত ধর্মপ্রাণ মানুষরা তাদের সন্তানদেরকে পাঠিয়ে থাকেন। দ্বীন ইসলাম ভালো করে শেখানোর জন্য অনেক মানুষ মাদ্রাসায় দান করেন, জমি ওয়াকফ করেন আখেরাতে মুক্তির কথা চিন্তা করে। কিন্তু সেই মাদ্রাসায় যদি ধর্মহীন, নীতিহীন শিক্ষার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করা হয়, তখন ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া খুবই স্বাভাবিক। মাদ্রাসা শিক্ষা যেহেতু একটি বিশেষায়িত শিক্ষা, এ শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে বিশেষজ্ঞ আলেমে দ্বীনদের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। মাদ্রাসা শিক্ষা যেহেতু ইসলামী শিক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা, অতএব এর সাধারণ বিষয়সমূহ মাদ্রাসা শিক্ষার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ঠিক রেখে সাজাতে হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা শিক্ষার নামে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা
নতুন পাঠ্য বইয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যৌনশিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭ থেকে ৪৯ পৃষ্ঠায় এমন এমন অনেক স্পর্শকাতর বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, যা ১১-১২ বছরের শিশুদের জন্য খুবই বেমানান। একই শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠের দশম অধ্যাযে "মানব শরীর" শিরোনামে নারী পুরুষের গোপন অঙ্গগুলো সম্পর্কে খুব খোলাখুলি আলোচনা করা হয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। ছোট ছোট শিশুদের সামনে এই বিষয়গুলো আলোচনা করা শিক্ষকদের জন্য খুবই বিব্রতকর। আরো ভয়াবহ দিক হচ্ছে, গ্রুপ ডিসকাশনের নামে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে বাধ্য হওয়ায় দিন দিন তাদের লজ্জা শরম চলে যাচ্ছে এবং তারা নানা ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে।
ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করার হীন চেষ্টা
নতুন পাঠ্য বইয়ের সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ৩৯ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শরীফ শরীফার গল্পের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টিকে প্রমোট করার চেষ্টা করা হয়েছে, এতে প্রকারান্তরে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামে সমকামিতা চরম ঘৃণ্য অপরাধ। এর মাধ্যমে পরিবার প্রথা ও পারিবারিক বন্ধন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর পারিবারিক বন্ধনের বাইরে যখন কোন নারী বা পুরুষ কোনো ধরনের যৌন আচরণে লিপ্ত হবে, তার দ্বারা সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং অনৈতিকতার ব্যাপক সয়লাব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিবাহ বহির্ভুত যৌনতা সহজলভ্য হয়ে গেলে বিশেষ করে নারীরা হয়ে যাবে গুরুত্বহীন ও অধিকার বঞ্চিত। এভাবেই তারা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হবে, যা কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না। অতএব পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সমকামিতাকে উৎসাহিত করে চরম সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না।
অসার এবং অবৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদ আলোচনা
নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে নানা কৌশলে বিবর্তনবাদকে প্রমোট করা হয়েছে। ২০২৩ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতিবাদের মুখে বিবর্তনবাদ সরিয়ে নেওয়া অথবা অযৌক্তিক অংশগুলো বাদ দেয়ার কথা বলা হলেও এখনো সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ে বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা রয়ে গেছে। পৃথিবীর অনেক দেশ বিবর্তনবাদের থিউরি আর গ্রহণ করছে না। সেখানে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক এ মতবাদকে ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশ বাংলাদেশের শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক। নতুন পাঠ্যবই থেকে বিবর্তনবাদ সরিয়ে দিয়ে মানব জাতির সৃষ্টি রহস্য এমনভাবে উপস্থাপন করা দরকার, যা আমাদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং কুরআন-হাদিস দ্বারা সমর্থিত ও প্রমাণিত।
ধর্মশিক্ষা সংকোচন
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী স্কুলে ধর্মশিক্ষাকে বিভিন্ন উপায়ে সংকুচিত করা হয়েছে। ধর্মশিক্ষা বিষয়ের শিখন ঘন্টা তুলনামূলকভাবে অনেক কম রাখা হয়েছে। বোর্ড পরীক্ষা থেকে ধর্মশিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছিল। ব্যাপক প্রতিবাদের ফলে তা পুনর্বহাল করা হলেও এখনো নানা উপায়ে ধর্মশিক্ষাকে কোনঠাসা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে ধর্মশিক্ষা সংকুচিত ও উপেক্ষিত হলে ধর্মহীন প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
সার্বিক বিবেচনায় নতুন কারিকুলামে যে ভয়াবহ সমস্যা রয়েছে তার প্রভাব থেকে আমাদের শিশু ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য এখনই আমাদেরকে নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।
১. মসজিদে জুমার খুতবায়, পত্র-পত্রিকায় সংবাদ, কলাম, নিবন্ধ লিখে, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের কাছে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও সুপারিশ উপস্থাপন করতে হবে।
২. নানাভাবে বিদেশি শক্তির অবৈধ হস্তক্ষেপ ও অন্যায় প্রভাবের মাধ্যমে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমল পরিবর্তন এনে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানার বিষয়ে জাতিকে সজাগ করতে হবে।
৩. শুধু সভা-সেমিনার নয়, সুপরিকল্পিতভাবে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ধর্মভিত্তিক বিশেষ করে মুসলিম শিশুদের জন্য ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলে এমন পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।
৪. স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের অবসর সমযে ইসলামী/ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষায়িত মাদ্রাসা বা ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬. মসজিদ ভিত্তিক মক্তব শিক্ষা আরো জোরদার করে প্রতিটি মুসলিম শিশুকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. বর্তমান যুগে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ায় শিশুদের ইসলামিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানা ধরনের অনলাইন প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৮. সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানানোর পরেও যে সকল বিষয় সংশোধন করা হচ্ছে না, অকাট্ট যুক্তি ও সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলো সকলের কাছে তুলে ধরার জন্য ভিডিও তৈরি করতে হবে।
৯. নতুন কারিকুলামের সমস্যাগুলো শিক্ষার্থীদের সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরা ও ভালোভাবে বুঝানোর জন্য ধর্মীয় আদর্শে উজ্জীবিত শিক্ষকদের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির সকল বিষয়ের পাঠ্যবই অনলাইনে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভিডিও আকারে তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।
১০. সরকার সবসময় উন্নয়ন ও দুর্নীতি দমনের কথা বলে। তাই সরকারকে নানা উপায়ে সুন্দর করে বুঝাতে হবে যে, ধর্মীয় মূল্যবোধে গড়ে ওঠা আদর্শ নাগরিকরা কখনো দুর্নীতির সাথে যুক্ত হবে না, অনৈতিক আচরণ করবে না এবং উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
যেকোনো ধর্মবিশ্বাসী মানুষ চায় তার সন্তান যথাযথভাবে ধর্মশিক্ষা লাভ করুক, ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে জীবন গড়ুক। ধর্মবিশ্বাসীরা কখনও চায় না, তাদের সন্তানরা ধর্মহীন হয়ে বেড়ে উঠুক, নানা ধরনের অপকর্ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ুক, আর এসবের কারণে জাহান্নামের আগুনে জ্বলুক। তারা মনেপ্রাণে চায় চিরস্থায়ী শান্তির নিবাস জান্নাতেও সন্তানদের নিয়ে একত্রে শান্তিতে বসবাস করতে। সচেতন অভিভাবক হিসেবে আমরা চাই- মাদ্রাসা শিক্ষা তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে থাকুক। ধর্মবিশ্বাসী নাগরিক হিসেবে আমরা চাই- আমাদের সন্তানরা স্কুলেও ধর্ম শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ পাক। যেহেতু আল্লাহভীতি ছাড়া অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, ও অন্যান্য খারাপ কাজ থেকে বাঁচা যায় না, তাই তারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা শিখুক। তারা ইহলৌকিক জীবনে কল্যাণের পাশাপাশি পারলৌকিক জীবনেও কল্যাণ লাভের উপায় সম্পর্কে ভালো করে জানুক। যে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে আল্লাহর নাম নিয়ে, ইনশাআল্লাহ বলে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বহুবার তাঁর নামাজ আদায় ও পবিত্র কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের বিষয় উল্লেখ করেছেন, যে দেশের ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলাম বিরোধী কোনো আইন পাশ করা হবে না বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সে দেশের সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় মেনে নেয়া যায় না। আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন বিষয় সরিয়ে ফেলতে অতি দ্রুত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জোরালো হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
(এটি সম্পুর্ণ লেখকের নিজস্ব মতামত)