ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ক্রয়-বিক্রয় নীতি

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ক্রয়-বিক্রয় নীতি

ইসলামী ব্যাংকগুলো ব্যাংক পরিচালনায় শরিয়া প্রতিপালনে বদ্ধপরিকর। এসব ব্যাংক ইসলামী নীতিমালার আলোকে বিনিয়োগ কার্যক্রম (Islamic Modes of Investment) পরিচালনায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো সাধারণত তিনটি নীতিতে অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। সেই নীতিগুলো হলো : ১. ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি।


২. অংশীদারি পদ্ধতি। ৩. ভাড়াদান পদ্ধতি।

ক্রয়-বিক্রয় নীতির আলোকে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে গ্রাহকের পক্ষে পণ্য বা দ্রব্য ক্রয় করে এবং ক্রয়মূল্যের সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ ও উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে মুনাফা যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে তা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় নীতির আওতায় বিনিয়োগ পদ্ধতি চার ধরনের।


যথা :

ক. বাই মুরাবাহা (লাভে বিক্রি)। বাই মুরাবাহা মানে চুক্তির ভিত্তিতে লাভে বিক্রি। নগদে বা ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে একসঙ্গে কিংবা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতিক্রমে মুনাফা ধার্য করে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরিয়ত অনুমোদিত পণ্য বিক্রি করাকে বাই মুরাবাহা বলা হয়।


ব্যাংকিংয়ে বাই মুরাবাহা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিনটি পক্ষ থাকে।


এক. ব্যাংক (অর্থায়নকারী)। দুই. পণ্য বিক্রেতা (যার কাছ থেকে ব্যাংক পণ্য ক্রয় করে)। তিন. ক্রেতা বা গ্রাহক (যার কাছে ব্যাংক পণ্য বিক্রি করে)।

বাই মুরাবাহার বৈশিষ্ট্য হলো, ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মত নির্ধারিত লাভে বিক্রি। ক্রয়মূল্য ও মুনাফা ক্রেতাকে পৃথকভাবে জানাতে হয়।


পণ্য ক্রয় করে পরে বিক্রি করতে হয়। পণ্যের অস্তিত্ব থাকতে হবে এবং ক্রয়যোগ্য হতে হবে। রূপান্তরের সুযোগ ও ঝুঁকি নিতে হবে। লাভ শতকরা হারে নির্ধারিত হতে পারে। চুক্তির পর নির্ধারিত মূল্য বৃদ্ধি করা যায় না ইত্যাদি।

বাই মুরাবাহা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত (মর্টগেজ, হাইপোথেকেশন, লিয়েন বা চার্জ আকারে) নিতে পারে। এবং তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের গ্যারান্টি নিতে পারে।


মুরাবাহাভিত্তিক বিনিয়োগে মৌলিক ত্রুটি হলো, অনেকে মনে করেন মুরাবাহা সব ধরনের আর্থিক লেনদেনে করা যায়। এটি সঠিক নয়। গ্রাহক যখন কোনো পণ্য ক্রয় করে তখনই শুধু মুরাবাহা পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। তা ছাড়া এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য বুঝে পাওয়ার আগেই গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি হয়ে গেছে। এটিও মুরাবাহাভিত্তিক বিনিয়োগের বিচ্যুতি। অন্যদিকে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আগে ক্রয় করা পণ্যের বিপরীতে মুরাবাহা বিনিয়োগ করা হয়। এটি শরিয়তে নিষিদ্ধ।


খ. বাই মুয়াজ্জাল (বাকিতে বিক্রি)। এর মানে হলো, নির্ধারিত সময়ে দাম পরিশোধ করার শর্তে বাকিতে বিক্রি। অর্থাৎ ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়ে একসঙ্গে বা কিস্তিতে সম্মত মূল্য পরিশোধের শর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরিয়ত অনুমোদিত পণ্য বিক্রি করাকে বাই মুয়াজ্জাল বলা হয়।


বাই মুয়াজ্জালের বৈশিষ্ট্য হলো, নির্ধারিত দামে বাকিতে বিক্রি করা হয়। পণ্য ক্রয় করে মালিকানা লাভ করে বিক্রি করতে হবে। বাই মুয়াজ্জাল চুক্তির সময় পণ্যের অস্তিত্ব থাকতে হবে এবং তা ক্রয়যোগ্য হতে হবে। ব্যাংক (বিক্রেতা) পণ্যের দাম ও তার মুনাফা গ্রাহককে বলতে বাধ্য নয়। হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত ব্যাংককে পণ্যের ঝুঁকি বহন করতে হয়।


ব্যাংকিংয়ে বাই মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরিয়তের দৃষ্টিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায়। যেমন—গ্রাহককে নগদ সুবিধা দেওয়া, গ্রাহকের নামে ক্যাশ মেমো নেওয়া, ক্যাশ মেমো রেকর্ডে না রাখা, বিনিয়োগ বিতরণের আগে বা পরের তারিখে ক্যাশ মেমো নেওয়া, শাখার পরিবর্তে গ্রাহক বিক্রেতা থেকে সরাসরি মাল বুঝে নেওয়া, পণ্য বুঝে নেওয়ার রেকর্ড না থাকা, এমপিআই/ডিলারশিপের বেলায় লেটার অব অথরিটি না নেওয়া, নতুন বিনিয়োগ সৃষ্টি করে পুরনো বিনিয়োগ সমন্বয় করা ইত্যাদি।


গ. বাই সালাম (অগ্রিম ক্রয়)। বাই সালাম হলো পণ্যের আগাম ক্রয়-বিক্রয়। এটি সাধারণত কৃষিক্ষেত্র ও কুটিরশিল্পে বিনিয়োগের বেলায় ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে সরবরাহের শর্তে এবং তাৎক্ষণিক সম্মত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরিয়ত অনুমোদিত পণ্য অগ্রিম বিক্রি করাকে বাই সালাম বলা হয়।


বাই সালামের বৈশিষ্ট্য হলো, অগ্রিম ক্রয়, আগে দাম পরে পণ্য। পণ্যের দাম চুক্তির সময় দিতে হয়। এই পদ্ধতিতে অর্থায়নের সময় পণ্যের অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। পণ্যের নাম, বিবরণ, পরিমাণ, গুণাগুণ, আকার ও দাম সুস্পষ্টভাবে চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে হয়। সরবরাহের সময় ও স্থান আগে থেকে জানা থাকতে হবে। পণ্য পরিমাণযোগ্য, ওজনযোগ্য, গণনাযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য হতে হবে।


ঘ. বাই ইসতিসনা (অর্ডারের ভিত্তিতে ক্রয়)। বাই ইসতিসনা মানে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোনো জিনিস নির্মাণ বা উৎপাদন করে দেওয়ার জন্য কোনো দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া।


অর্থাৎ ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে বা কিস্তিতে সম্মত মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রেতার আদেশে নির্দিষ্ট পণ্য তৈরি করে বিক্রি করাকে বাই ইসতিসনা বলা হয়। এই লেনদেনে পণ্য অস্তিত্ব লাভ করার আগেই বিক্রি করা হয়।


বাই ইসতিসনার বৈশিষ্ট্য হলো, পণ্যের দাম অগ্রিম/এককালীন/কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য। উৎপাদন ব্যয় নির্বাহের জন্য পণ্যের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করা যায়। উৎপাদনকাজ শুরু হলে চুক্তি বাতিল করা যায় না। পণ্য কোথায়, কিভাবে, কার খরচে সরবরাহ হবে, তা চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে হবে। কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে দায়ী পক্ষের ওপর নির্দিষ্ট জরিমানা আরোপ করা যাবে—এমন শর্ত চুক্তিতে রাখা যাবে।


আবাসিক ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাই ইসতিসনা একটি উপযোগী বিনিয়োগ পদ্ধতি। যদি কোনো গ্রাহক একখণ্ড জমির মালিক হন এবং বাড়ি নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় তাহলে ব্যাংক বা বিনিয়োগদাতা ইসতিসনার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে পারে। একইভাবে আধুনিক বহু প্রকল্প পরিচালনায় এটি উপযোগী বিনিয়োগ পদ্ধতি।


লেখক : ধর্ম বিভাগীয় প্রধান, দৈনিক কালের কণ্ঠ