শুধু আলু নয়– উদ্যোক্তারা এখন পেঁয়াজ, গাজরের জন্যও কোল্ড স্টোরেজে বিনিয়োগ করছেন

শুধু আলু নয়– উদ্যোক্তারা এখন পেঁয়াজ, গাজরের জন্যও কোল্ড স্টোরেজে বিনিয়োগ করছেন

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে ৪০০টিরও বেশি কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা রয়েছে, যা মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই উদ্যোক্তারা এখন একটু দেরিতে হলেও পেঁয়াজ, গাজরসহ বিভিন্ন পণ্যের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ কোল্ড স্টোরেজ তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। 


দুই দশক আগে রাজশাহীতে ৩,০০০ টন পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করে এক উদ্যোক্তা পরপর দুইবছর লোকসান গুনে তা বন্ধ করে দেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারও নতুন আরেক উদ্যোক্তা আকারে ছোট হলেও নতুন করে পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করেছেন।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে ৪০০টিরও বেশি কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা রয়েছে, যা মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

অ্যাসোসিয়েশন বলছে, শুধুমাত্র সংরক্ষণাগারের মাধ্যমে যেভাবে এক মৌসুমের আলু দিয়ে সারাবছরের সরবরাহ নিশ্চিত হয়, সেভাবেই এখন উদ্যোক্তারা একটু দেরিতে হলেও পেঁয়াজ, গাজরসহ বিভিন্ন পণ্যের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ কোল্ড স্টোরেজ তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। 

জায়ান্ট অ্যাগ্রো প্রোসেসিং লিমিটেড ময়মনসিংহের ভালুকাতে ৫০০ টন ধারণক্ষমতার একটি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করেছে হল্যান্ডের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আগামী মাসেই এটির উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। 

জায়ান্ট অ্যাগ্রো প্রোসেসিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ এম হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরীক্ষামূলকভাবে পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করেছি। আগামী মাসে এটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকলেও পেঁয়াজ সংরক্ষণের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।"

এর আগে ২০০৪ সালে রাজশাহীর ফজলুর রহমান পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করেন। প্রায় ১৫ কোটি ব্যয়ে তৈরি করা ৩,০০০ টন ধারণক্ষমতার ওই স্টোরেজটি মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে না পেরে শেষে পেঁয়াজ সংরক্ষণ বন্ধ করে দেন এই উদ্যোক্তা। 

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ২০২০ সাল থেকেই পেঁয়াজের জন্য একটি কোল্ড স্টোরেজ তৈরির চেষ্টা করতে থাকলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। 

কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে— দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩৪ লাখ টনের বেশি, যেখানে চাহিদা ২৭.২৮ লাখ টন। কিন্তু কমপক্ষে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পোস্ট হার্ভেস্ট লসের কারণে ব্যবহার উপযোগী পেঁয়াজের সরবরাহ নেমে আসে ২৫ লাখ টনে। 

ফলে প্রতি বছর আরও অন্তত ৫ থেকে ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। সময় কম লাগার কারণে আমদানির বেশিরভাগই ভারত থেকেই আসে। যে কারণে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি কখনো বন্ধ করলেই বাংলাদেশে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ২৭০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ডও রয়েছে।

ফিরোজ এম হাসান বলেন, "আমরা পেঁয়াজ সংরক্ষণের বিষয়টা ভালোভাবে করতে পারলে আমাদের আমদানি বাজারের ওপর আর নির্ভর করতে হবে না।"

শুধু পেঁয়াজ নয়, আমদানি নির্ভরতা রয়েছে এমন অনেক পণ্যেই এবার উদ্যোক্তারা কোল্ড স্টোরেজ তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছেন। যাতে করে এক মৌসুমের উৎপাদিত পণ্য বছরজুড়ে সরবরাহ নিয়মিত রাখা যায়। 

১৯৭৪ সাল থেকে হিমাদ্রি লিমিটেড ৫০ বছর ধরে কেবল আলুর কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সব মিলে কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা ৭টি। তবে এই সময়ে এসে প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষামূলকভাবে একটি গাজর সংরক্ষণের কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। 

প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে কোল্ড স্টোরেজটির অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এরজন্য তারা কম খরচের ঋণের মাধ্যমে মূলধন যোগানের চেষ্টা করছেন। মূলত কম সুদের ব্যাংক ঋণ বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টায় আছেন তারা।

প্রতিবছর দেশে ১২,০০০ টনের বেশি গাজর আমদানি করা হয়; যা মূলত চীন এবং ভারত থেকে আসে। দেশের উৎপাদন মৌসুমে ৩০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় গাজর। উৎপাদন মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ের পর সাধারণত গাজর আমদানি হয় এবং তা সারাবছর বিক্রি হয় চড়া দামে। আমদানি হয়ে আসা এসব গাজর ১৫০ টাকা পর্যন্ত দামেও ঢাকার বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২.৮৩ মিলিয়ন ডলার বা ২৭ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে গাজর আমদানির পেছনে। অথচ দেশে প্রতিবছর এই পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ দেড় লাখ টনের বেশি।

উদ্যোক্তারা বলছেন, শীতকালে যে পরিমাণ গাজর উৎপাদন হয়, তার একাংশও যদি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়— তবে পণ্যটির আমদানি করার দরকার পড়বে না। সারাবছর এখান থেকেই যোগান দেওয়া সম্ভব হবে। 

হিমাদ্রি লিমিটেডের পরিচালক এবং বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইশতিয়াক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "যেসব কৃষিপণ্য আমাদের দেশে প্রচুর উৎপাদন হওয়ার পরও আমদানি করতে হয়, সেগুলো সংরক্ষণে আমরা কাজ শুরু করেছি, পরিকল্পনা করছি। প্রাথমিকভাবে, আমরা এখন গাজরের একটি কোল্ড স্টোরেজ তৈরির কাজ হাতে নিয়েছি।" 

তিনি বলেন, "পণ্যটি আমাদের দেশে একটি মৌসুমে উৎপাদন হচ্ছে এবং তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ সারাবছরই এর চাহিদা রয়েছে, যা মেটানো হচ্ছে আমদানি করে। নিজেরা স্টোরেজ সিস্টেম ডেভেলপ করলে আমদানির ওপর আর নির্ভর করতে হবে না।"

প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি ৮০০-১,০০০ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ করবে। আলুর সংরক্ষাণাগার থেকে এর প্রযুক্তি হবে ভিন্ন। কারণ আলু সংরক্ষণ করা হয় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। যেখানে গাজর সংরক্ষণ করতে হবে শূন্য ডিগ্রিতে। 

ব্যবসায়িক স্বার্থে এখনই বিনিয়োগের পরিমাণ প্রকাশ করতে চান না ইশতিয়াক আহমেদ। তবে কোল্ড স্টোরেজ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে যেসব কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করা হয়, সেগুলোর প্রতিটি চেম্বারের ধারণক্ষমতা ২.৫-৩ হাজার টনের মত। এ ধরনের একটি চেম্বার করার জন্য দরকার পড়ে সাড়ে৬ থেকে ৭ কোটি টাকা। 

ইশতিয়াক আহমেদ জানান, কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কিছু উদ্যোক্তা পেঁয়াজ, রসুনের মত পণ্যগুলোর কোল্ড স্টোরেজ তৈরির জন্য বিশেষভাবে কাজ করছেন। পরিকল্পনা আগে থেকেই হচ্ছে, এখন শুধু এগুলো সম্পাদনের পর্যায়ে যাচ্ছে। 

তবে উদ্যোক্তারা ডাইভারসিফাইড বা বৈচিত্র্যময় পণ্যের কোল্ড স্টোরেজে বিনিয়োগের জন্য স্বল্প সুদে তহবিল চান।

কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, "বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদ ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে আমরা প্রজেক্ট করলে সেটা লাভজনক করা মুশকিল হয়ে পড়বে। এ কারণে সরকার যদি আমাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে, বা বিদেশ থেকে ফান্ড নিয়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়, তাহলে আমরা এ খাতে সহজে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবো।"

তিনি বলেন, "দেশের কোল্ড স্টোরেজগুলোর অধিকাংশেরই ৪টি করে চেম্বার রয়েছে। যেগুলো দুর্বলভাবে ব্যবসা করছে, সেগুলোর একটি বা দুটি চেম্বারকে বিশেষভাবে পেঁয়াজ বা অন্য পেরিশেবল কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য দরকার বিনিয়োগ; স্বল্প খরচে যাতে বিনিয়োগ করতে পারি– সেজন্য সরকারের সহযোগীতা দরকার।" 

ব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জ

অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে চার শতাধিক কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে, যেগুলোতে আলু সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্যোক্তারা এখন পেঁয়াজ, টমেটো, গাজর, মাংস, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্য সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ তৈরিতে নতুন বিনিয়োগ করতে চান।

কিছু পণ্য রয়েছে যেগুলো হয়তো কোল্ড স্টোরেজে লম্বা সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা যায় না, সেগুলো প্রসেসিং এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হয়। এ প্রযুক্তিগুলোও সংরক্ষণ সিস্টেমে যুক্ত করতে চান উদ্যোক্তারা। 

তবে এক্ষেত্রে আরও একটি বাধার কথা জানালেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, কোল্ড স্টোরেজের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্র হলো কমপ্রেসার। কোল্ড স্টোরেজের জন্য এই কমপ্রেসারটি আমদানি করতে ১ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয় না। কিন্তু কমপ্রেশারের কোনো একটি পার্টস আমদানি করতে গেলে তার জন্য ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়। এই শুল্ক হার ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসার দাবি করেন উদ্যোক্তারা। 

বাংলাদেশ রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার-কন্ডিশনিং মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং এফবিসিসিআই-এর রেফ্রিজারেশন, এয়ার কন্ডিশনিং এবং কোল্ড চেইন পলিসি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, "একটি পণ্য ব্যবহার করলে তার কোনো না কোনো পার্টস একসময় নষ্ট হবেই। কিন্তু সেটি যদি ১৩০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আনতে হয়, সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের খরচ অনেক বেড়ে যায়। এ খরচ কমানো উচিত।" সুত্রঃ www.tbsnews.net