যে সিঙ্গেল  মাদারের ফোন কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারই ছেলে জেফ বেজোস এখন ১৬৩.৫ বিলিয়ন ডলারের মালিক!

যে সিঙ্গেল মাদারের ফোন কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারই ছেলে জেফ বেজোস এখন ১৬৩.৫ বিলিয়ন ডলারের মালিক!

মার্কিন বিলিয়নিয়ার ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এই মুহুর্তে বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি। ফোর্বসের ২০২৩ সালের আগস্টের হিসাব অনুযায়ী, বেজোসের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ১৬৩.৫ বিলিয়ন ডলার। চোখ ধাঁধানো সব বাড়ি, গাড়ি থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল জিনিসের সংগ্রহের কোনো কমতি নেই তার। কিন্তু এই বেজোসেরই জন্ম হয়েছিল দরিদ্র এক কিশোরি মায়ের ঘরে, যার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হতো, এমনকি একটা টেলিফোন কেনারও টাকা ছিল না তাদের কাছে।

কিন্তু শুধুমাত্র বেজোসের সফলতার গল্পই যে অনুপ্রেরণাদায়ক তা-ই নয়, তার মায়ের জীবনের গল্পও একই রকম অনুপ্রেরণাদায়ক। ২০১৯ সালে ক্যামব্রিজ কলেজের একটি প্রারম্ভিক বক্তব্যে জেফ বেজোসের মা জ্যাকলিন বেজোস তার জীবনের গল্প শেয়ার করেছিলেন, এর পরপরই বেজোস টুইট করেছিলেন 'আমার মায়ের জীবনের অবিশ্বাস্য গল্প… কি অসাধারণ! আমি খুবই কৃতজ্ঞ, খুবই গর্বিত।"
জ্যাকলিন বেজোসও এখন তার ছেলের মতোই সফল হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এই সফলতার পথটা সহজ ছিল না। ষাটের দশকে নিউ মেক্সিকোর অ্যালবুকেয়ারকিতে থাকতে জ্যাকলিন এবং ওই সময় টিনেজ বয়সেই গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ফলে সমাজের মানুষের বাঁকা দৃষ্টি সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। প্রথমে স্কুল প্রশাসন তাকে বলে যে তিনি আর হাইস্কুলে পড়াশোনা শেষ করতে পারবেন না। কিন্তু জ্যাকলিন অটল থাকেন এবং সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন, ফলে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে কিছু কঠিন শর্তসহ স্কুলে পড়াশোনার অনুমতি দেয়।

স্কুলের শর্তগুলো ছিল খুবই নিষ্ঠুর এবং অমানবিক; তাকে অন্যদের সাথে মেলামেশায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সময়ের সীমাবদ্ধতা তো ছিলই, এবং তাকে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এতকিছুর পরেও জ্যাকলিন ধৈর্য্য ধরে ছিলেন এবং হাইস্কুলের পড়া সম্পন্ন করেন।

জেফ বেজোসের বয়স যখন ১৭ মাস, তখন তার বাবা টেড ইয়োর্গেনসেনকে ডিভোর্স দেন জ্যাকলিন।  এরপরে তিনি একজন সেক্রেটারি হিসেবে চাকরি নেন। ওই চাকরি থেকে তিনি মাসে মাত্র ১৯০ ডলার আয় করতেন, কিন্তু তা দিয়েই তিনি ছেলেকে নিয়ে আলাদা একটি অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। নিজের বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে একটা ফোন কেনার টাকাও ছিল না তার কাছে, তাই তার বাবা একটা ওয়াকি-টকি দিয়ে দেন তাকে দৈনন্দিন যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য।

জ্যাকলিন চেয়েছিলেন তার পড়াশোনা শেষ করতে। সেজন্য তিনি আবার নৈশ স্কুলে ভর্তি হন এবং তিনি বেজোসকে ওই ক্লাসে নিয়ে যেতেন। পাঠ্যবই এবং বাচ্চার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুটি ব্যাগে ভরে তিনি হাজির হতেন স্কুলে।
নৈশ স্কুলে পড়ার সময়েই জ্যাকলিনের পরিচয় হয় মাইক বেজোসের সঙ্গে, যিনি ছিলেন একজন কিউবার শরনার্থী এবং পরে জ্যাকলিন তাকে বিয়ে করেন। জেফ এই ব্যক্তিটিকেই ভালোবেসে নিজের বাবা বলে সম্বোধন করে থাকেন। পরে মাইকের চাকরির কারণে তাদের অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে হয় এবং জ্যাকলিনের কলেজে গ্র্যাজুয়েশনের স্বপ্নও কয়েক বছর অধরাই থেকে যায়।

কিন্তু একের পর এক বাধার সম্মুখীন হয়েও জ্যাকলিন হাল ছেরে দেননি এবং পড়াশোনার স্বপ্নও তার শেষ হয়ে যায়নি। তার সন্তানরা যখন কলেজে গেল, তখন জ্যাকলিনেরও তাদের সাথে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা জাগলো। বারবার দেরি হওয়া এবং নানা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার পর তিনি আবারও কলেজে ভর্তি হলেন। অবশেষে হাইস্কুলের পড়া শেষ করার দুই দশক পরে তিনি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।

অনুষ্ঠানের সুচনা বক্তব্যে তিনি আরও বলেছিলেন, "যখন আমি ৪০ বছর বয়সে সেন্ট এলিজাবেথ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম, ওই সময়ের চেয়ে গর্বিত আর কখনো নিজেকে মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল আমার অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছি, অনেক বড় কিছু অর্জন করেছি। শেষ পর্যন্ত যখন ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিতে মঞ্চে উঠলাম, তখন সবচেয়ে জোর করতালি ও উৎসাহ পেয়েছি আমার পরিবারের কাছ থেকেই।"

জেফ বেজোসকে লালন-পালনের পাশাপাশি আমাজনের প্রতিষ্ঠাতার বিলিয়নিয়ার হয়ে ওঠা ও তার সফলতার যাত্রায়ও আর্থিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন জ্যাকলিন ও মাইক বেজোস। জেফ বেজোস তার বাবা-মায়ের কাছে এক সাহসী প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তার নতুন ওয়েবসাইট আমাজন ডটকম প্রতিষ্ঠার জন্য। তারা জেফকে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৩ ডলার ধার দিয়েছিলেন; যা ওই সময়ে ইন্টারনেটে প্রাথমিক যুগে ছিল একটা বড় বাজি ধরার মতো ব্যাপার। তাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে এই বিনিয়োগই একদিন ইতিহাসে সবচেয়ে লাভজনক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।

আজ জ্যাকলিন-মাইকের ধার দেওয়া সেই ২ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৩ ডলার ফুলে ফেঁপে প্রায় ৯৫৮ বিলিয়ন ডলারের এক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে! জেফ বেজোসের পরিবার তার উপর বিশ্বাস করেছিল, আর সেই বিশ্বাসের ফল তারা অবিস্মরণীয়ভাবেই পেয়েছে এবং তারা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী পরিবারগুলোর একটি।

ব্লুমবার্গের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে জ্যাকলিন এবং মাইকের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ তা ১২,০০০,০০০% হারে বেড়েছে।