পড়তে পড়তে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এম আসিফ রহমান
আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার-২০২৩-এ প্রযুক্তি শ্রেণিতে সেরা উদ্যোক্তা হয়েছেন এ আর কমিউনিকেশনসের প্রতিষ্ঠাতা এম আসিফ রহমান। কৈশোর থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে বসবাস তাঁর। বর্তমানে বিশ্বের ৬০ লাখের বেশি ওয়েবসাইটে তাঁদের তৈরি ওয়ার্ডপ্রেস টুল ব্যবহৃত হয়।
কৈশোরেই প্রথম ওয়েব ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এম আসিফ রহমানের। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই মা-বাবা কম্পিউটার কিনে দেন তাঁকে। আসিফ সেই সময়কার কথা বলেন এভাবে, ‘আমি কম্পিউটারে কোনো গেম খেলতাম না। তার বদলে কিউব্যাসিক, প্যাসকেলসহ নানা বিষয়ে শেখা শুরু করি। ২০০১ সালে ঈশ্বরদী থেকে ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তির মাধ্যমে নতুন করে আরও অনেক কিছু জানার সুযোগ পাই।’
ব্লগিং ও প্রযুক্তি নিয়ে লেখালেখির আগ্রহ ছিল আসিফের। সে সময়ের জনপ্রিয় ইয়াহু জিওসিটিস ও পরে ব্লগার ডটকম দিয়ে নিজের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন তিনি। তখন তাঁর ওয়েব প্রোগ্রামিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল বেসিক লেভেলের এইচটিএমএল। পরে আসিফ খোঁজ পান ওয়ার্ডপ্রেসের। বর্তমান সময়ে ওয়ার্ডপ্রেস জনপ্রিয় হলেও ২০০৩-০৪ সালে হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। তখন ওয়ার্ডপ্রেসে ওয়েবসাইট তৈরি থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্লাগইন তৈরি শুরু করেন আসিফ।
পরবর্তী সময়ে আসিফ সফল প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুকের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে বিনিয়োগও করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ডব্লিউপিডেভেলপার নামের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগইন তৈরি করছে। বর্তমানে বিশ্বের ৬০ লাখের বেশি ওয়েবসাইটে তাদের তৈরি ওয়ার্ডপ্রেস টুল ব্যবহৃত হয়।
প্রযুক্তির দুনিয়ায় আগমন
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে জিডি পাইলট হিসেবে বিএমএতে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন আসিফ। তবে প্রশিক্ষণ শেষ না করেই ২০০৪ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অবশ্য তার আগেই এ আর কমিউনিকেশনস নামের ডিজিটাল এজেন্সি শুরু করেন। শুরু থেকে ওয়ার্ডপ্রেসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ম্যাট মুলেনওয়েগের সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। সে সময় ওয়ার্ডপ্রেস মাত্র জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
আসিফ ২০০৮ সালে প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট টেক জার্নাল শুরু করেন। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে মাসে দুই কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলকে পৌঁছায় এই ওয়েবসাইট। তখন তিনি নিয়মিত অংশ নেন ওয়ার্ডপ্রেসের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আয়োজনে। একবার তো একটানা ছয়টি ওয়ার্ডক্যাম্পে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৯টি অঙ্গরাজ্যে ঘোরেন। বোস্টন থেকে শুরু করে সান ফ্রান্সিসকো ছুটে বেড়ান। পরে ২০১১ সালে মেলবোর্নের ওয়ার্ডক্যাম্পে প্রথম বাংলাদেশি বক্তা হিসেবে অংশ নেন আসিফ।
ফেসবুকে বিনিয়োগ
২০১১-১২ সালে ফেসবুক আইপিও ছাড়ে। তত দিনে আমেরিকার বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আসিফের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ফেসবুকে বিনিয়োগ করেন তিনি। শুধু ফেসবুক নয়, বন্ধুরা মিলে বেশ কিছু প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানেও বিনিয়োগ করেন।
আসিফ বলেন, ‘আমার কিছু বন্ধু ছিল, যাদের মধ্যে ওয়ার্ডপ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাট মুলেনওয়েগও ছিল। আমরা সবাই মিলে ফেসবুকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিই। তখন ফেসবুক তার সিরিজ ডি ভিসি রাউন্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ গ্রহণ করছিল। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রায় ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিলাম। ফেসবুকসহ আমেরিকার বিভিন্ন ছোট প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানেও আমরা একটি দল হিসেবে বিনিয়োগ করেছি।’
ডব্লিউপিডেভেলপারের যাত্রা
২০১১ সালে ‘ডব্লিউপিডেভেলপার’ নামে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আসিফ। ওয়ার্ডপ্রেসের জন্য প্লাগইন তৈরির ওই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১৩০ জনের বেশি কর্মী কাজ করেন। আসিফ বলেন, ‘আমরা গ্রাহক ও ব্যবহারকারীদের চাহিদা অনুযায়ী ওয়ার্ডপ্রেসের বিভিন্ন ধরনের প্লাগইন তৈরি করছি। এখন ৬০ লাখের বেশি ওয়েবসাইটে আমাদের তৈরি ওয়ার্ডপ্রেস টুল ব্যবহৃত হয়।’
আসিফ জানান, ওয়ার্ডপ্রেসের সবচেয়ে বড় পেজ বিল্ডার এলিমেন্টরের জন্য মোস্ট পপুলার টুল ‘Essential Addons’ তৈরি করেছে ডব্লিউপিডেভেলপার। Essential Addons নামের এই টুল এখন বিশ্বের ২৩ লাখের বেশি মানুষ ব্যবহার করছেন। সেলসের জন্য নোটিফিকেশনএক্স, ওয়েবসাইট ঠিকানা ছোট করার জন্য বেটারলিক্স, কনটেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য শিডিউলপ্রেস, পেমেন্টের জন্য বেটার পেমেন্টসহ বিভিন্ন প্লাগইন বেশ জনপ্রিয়।
আসিফ আরও জানান, ২০১৯ সালে তাঁরা ‘সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস (স্যাস)’ খাতে কাজ শুরু করেন। ওই বছরই তাঁরা তাঁদের প্রথম স্যাস পণ্য ইজি ডটজবস চালু করেন। বৈশ্বিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম শপিফাইয়ের জন্য বিভিন্ন অ্যাপ তৈরি করছেন তাঁরা। ওয়ার্ডপ্রেসের দুনিয়ার বাইরেও প্রযুক্তির অনেক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছেন বলে জানান আসিফ।
প্রযুক্তি উদ্যোগের বিকাশে আসিফ
বাংলাদেশের প্রযুক্তি উদ্যোগের বিকাশের জন্য ২০০৮ সাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন আসিফ। উদ্যোগ বিকাশের পরিবেশ, অনলাইন ব্যবসা ও উদ্যোগে তরুণদের আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হন তিনি। ২০১২ সালে যুক্ত হন স্টার্টআপ উইকেন্ডের আয়োজনের সঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানে বিনিয়োগকারী হিসেবেও অংশ নেন তিনি। পরে গুগল ডেভেলপার গ্রুপের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিনির্ভর অনেক উদ্যোগে মেন্টর হিসেবে কাজ করেছেন। সঙ্গে বিনিয়োগও করেন। ২০১৩ সালে তিনি প্রথম ‘ডুগডুগি’ নামের একটি প্রযুক্তি উদ্যোগে বিনিয়োগ করেন।
আসিফ মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বেশ কয়েকটি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। ডব্লিউপিডেভেলপার, ইজি ডটজবস, স্টোরওয়্যার, টেমপ্লেটলি ডটকম, এক্সক্লাউডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে স্টারটাইজ নামের গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে ২৫টির বেশি উদ্যোগের পরামর্শক বা উদ্যোক্তারা মেন্টরিং গ্রহণ করেছেন।
সম্মাননা
আসিফ রহমান এ আর কমিউনিকেশনসের পক্ষে ২০২০ ও ২০২১ সালে শ্রেষ্ঠ রপ্তানিকারক হিসেবে বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ইজি জবসের মাধ্যমে বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি পুরস্কারের চ্যাম্পিয়ন স্টার্টআপ খেতাব পান। সুত্রঃ প্রথম আলো