প্যারিসে ‘সাইক্লিং বিপ্লব’ চলছে: নগরীতে এখন গাড়ির চেয়ে বাইসাইকেলের ব্যবহার বেশি
একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, প্যারিসে এখন মোট ট্রিপের ১১.২ শতাংশ দেওয়া হয় বাইসাইকেলের মাধ্যমে, আর ৪.৩ শতাংশ ট্রিপ দেওয়া চারচাকার গাড়ির মাধ্যমে।
প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ র্যু ডি রিভলি সড়কের ব্যস্ত সময়। এখান থকে লুভ্য মিউজিয়াম খুব কাছেই। একের পর এক বাইসাইকেল চলে যাচ্ছে সড়কটি দিয়ে। তবে পাঁচ বছর আগেও এই সড়কে ছিল গাড়ির রাজত্ব। তবে এখন এ সড়কে চলছে দ্বিচক্রযান বাইসাইকেলের দাপট।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমর্থনে প্যারিসে রীতিমতো সাইকেল বিপ্লব ঘটে গেছে। সরকারি সংস্থা প্যারিস রিজিয়ন ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী, প্যারিসের ভেতরের অঞ্চলে সাইকেল ইতিমধ্যে সংখ্যায় চারচাকার গাড়িকে ছাড়িয়ে গেছে। এ নগরীতে এখন মোট ট্রিপের ১১.২ শতাংশ দেওয়া হয় বাইসাইকেলের মাধ্যমে, ৪.৩ শতাংশ গাড়ির মাধ্যমে। সাইকেল ব্যবহারের এ প্রবণতা বাড়তে দেখা গেছে শহরতলি ও সিটি সেন্টারেও। ওসব অঞ্চলে মোট ট্রিপের ১৪ শতাংশ বাইসাইকেল ও ১১.৮ শতাংশ গাড়ির মাধ্যমে দেওয়া হয়।
র্যু ডি রিভলিতে টু-ওয়ে সাইকেল লেন আছে, বাস ও ট্যাক্সির জন্যও আছে আলাদা লেন। এ সড়কই সম্ভবত গত কয়েক বছরে প্যারিসের বদলে যাওয়ার সবচেয়ে জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। তবে একমাত্র দৃষ্টান্ত নয় মোটেই। বুলেভার্দ ডি সেবাস্তোপোল এখন সাইক্লিস্টদের সবচেয়ে ব্যবহৃত রুট হয়ে উঠেছে। দৈনিক ১০ হাজারের বেশি সাইকেল ট্রিপ দেওয়া হয় এ রুটে।
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে প্যারিসের এসব সড়কে এখন এত বেশি সাইকেল নামে যে মাঝে মাঝে যানজট লেগে যায়। নগর কর্তৃপক্ষ এসব সড়কের সমান্তরালে অন্যান্য সড়কে বাইক লেন ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন।
প্যারিসের ম্যাপ হাতে নিলে দেখবেন, উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সব দিকেই বাইসাইকেলকে বেশি সুবিধা দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, প্যারিসে ১ হাজার কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের রাস্তায় সাইক্লিস্টদের সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে বাইক লেন রয়েছে ৩০০ কিলোমিটার আর প্রভিশনাল লেন রয়েছে ৫২ কিলোমিটার। বাকি লেনগুলোতে বাইসাইকেলের পাশাপাশি গাড়িও চলে।
স্থানীয় কর্মকর্তারা ২০২৬ সালের মধ্যে গোটা প্যারিস নগরীকে দ্বিচক্রযানের মাধ্যমে চলাচলের উপযোগী করে তুলতে চান। নগরের মেয়র অ্যান হিডালগো সেজন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছেন। এই গ্রীষ্মের অলিম্পিক গেমস এই নতুন 'বাইক পরিকল্পনায়' গতি আনবে। অলিম্পিকের ভেনুগুলোতে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সাইকেল রুট তৈরি করা হবে।
তবে এখনও বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। নগরীতে সাইক্লিংয়ের পক্ষে কাজ করা সংগঠন প্যারিস এন সেলে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মেয়র হিসেবে হিডালগো দ্বিতীয় মেয়াদ ৬২ শতাংশ শেষ করে ফেললেও 'বাইক পরিকল্পনার' মাত্র ২৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। প্যারিস ফর ট্রান্সপোর্টেশনের ডেপুটি মেয়র ডেভিড বেলিয়ার্ড স্বীকার করেছেন, কাজ বাস্তবায়নে একটু দেরি হচ্ছে। তবে তিনি আশা হারাননি।
প্যারিসের কিছু রাস্তায় এখনই বাইকের সংখ্যা অন্যান্য যানবাহনকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পিক সময়ে বাইক বাইক লেনের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়েছে বলে উঠে এসেছে রাজধানীর ১২৮টি কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করা তথ্যে। নগর কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য ব্যস্ততম মেট্রো লাইনের সঙ্গে সাইক্লিংয়ের পথের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, যাতে একইসঙ্গে গণপরিবহনে চাপ কমানো এবং দ্রুতগামী বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়।
বাইসাইকেল ব্যবহার করে যাতায়াতকারী মানুষের সংখ্যাও প্যারিসের অনেক বেড়েছে। বাইসাইকেল ভাড়া দেওয়া প্রতিষ্ঠান ভেলিব গত মার্চ থেকে তাদের বহরে ৩ হাজার নতুন সাইকেল যোগ করেছে।
প্যারিসের ৬২ বছর বয়সি বাসিন্দা এদমি ডরোসলাই। তিনি বলেন, ১৯৮০-র দশকে যখন নগরীতে সাইকেল চালানো শুরু করেন, তখন এটি ছিল 'প্রায় অসম্ভব এবং ভীষণ বিপজ্জনক'। কিন্তু বিভিন্ন উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলায় এখন প্যারিসে ভালোভাবে সাইকেল চালাতে পারছেন।
২০২১ সালে প্যারিসে মোট ট্রিপের ৫.৬ শতাংশ দেওয়া হতো বাইসাইকেলের মাধ্যমে, ৯ শতাংশ ট্রিপ দেওয়া হতো গাড়ির মাধ্যমে।
প্যারিসের ভেতরে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গাড়ির চেয়ে বাইসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে। সেইসঙ্গে নিকটতম শহরতলিগুলোতেও বাইকের ব্যবহার বাড়তে দেখা গেছে। শহরতলিগুলোতে মোট ট্রিপের ১১.৮ শতাংশ গাড়ি ও ১৪ শতাংশ বাইসাইকেলের মাধ্যমে দেওয়া হয়। ব্যস্ত সময়ে মোট ট্রিপের মাত্র ৬.৬ শতাংশ গাড়ি ও ১৮.৯ শতাংশ বাইসাইকেলের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে মিউনিসিপালিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৩ শতাংশ যাতায়াতই হয় পায়ে হেঁটে, এরপর ৩০ শতাংশ যাতায়াত হয় গণপরিবহনে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর পেনশন সংস্কারের প্রতিবাদে প্যারিসে গণপরিবহনের ধর্মঘটের সময় থেকে ধীরে ধীরে সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে ২০২০ সালে করোনাকালে লকডাউন থেকে বের হওয়ার পর সাইকেলের ব্যবহার আরও বাড়তে থাকে।
বাইসাইকেলের সুবাদে বিভিন্ন এলাকার মধ্যে যোগাযোগ ভালো হয়েছে। নগরীর দক্ষিণের একটি শহরতলিতে বাইসাইকেল মেরামতের দোকানের মালিক আর্নো ফয়ের বলেন, 'নেটওয়ার্ক খুব ভালো।' দুই বছর ধরে প্যারিসে আছেন তিনি। প্রতিদিন ১৩ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে কাজে আসেন, আবার বাসায় ফিরেন। তবে তিনি দুটি সমস্যার কথা বললেন। এক, নিরাপদ পার্কিংয়ের অভাব। দুই, মাঝে মাঝে যানজট অনেক বেশি হয় যা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
সিটি হল-এর তথ্যানুসারে, ১২ বছরে প্যারিসে গাড়ি চলাচল ৪০ শতাংশ কমে গেছে। তবে সাইকেলের সংখ্যা দ্রুত বাড়ায় পথচারীসহ অন্যান্য চলাচলকারীদের নিরাপদে চলাচল নিয়ে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্যারিসজুড়ে এখন পোস্টার সাঁটিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, রাস্তায় পথচারীরা সবচেয়ে গুরুত্ব পাবেন এবং গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
বাইসাইকেলের জন্য পার্কিংয়ের জায়গা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে শহরটির। লক্ষ্য এখন নতুন ১ লাখ ৩০ হাজার পার্কিং স্পট তৈরি করা। বিশেষ করে ট্রেন স্টেশনগুলোতে ব্যাপক পরিসরে পার্কিংয়ের জায়গা তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
নগর কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য, শহরতলির যেসব বাসিন্দা নিয়মিত ট্রেনে করে কর্মস্থলে যান, তারাও যেন প্যারিসে ঢুকে বাইসাইকেল ব্যবহার করতে পারেন।
এ প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ, কেউ কেউ বিরোধিতাও করছেন। তবে প্যারিসের চেহারা বদলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিরাপদে বাইসাইকেল চলাচলের জন্য উপযোগী হয়ে উঠছে এ নগরী।সুত্রঃ tbsnews.net