ফাইভ আওয়ার রুল: সাফল্য অর্জনে জ্যাক মা, বিল গেটস ও ইলন মাস্করা যে নিয়মে চলেন
জীবনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে যদি পড়াশোনায় মাত্র এক ঘণ্টার অখণ্ড মনোযোগই যদি যথেষ্ট হয়, সেটা জেনে অবাক হবেন অনেকেই। কিন্তু, যারা শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত আছেন তাদের ক্ষেত্রে এ কৌশল অত্যন্ত ফলদায়ক প্রমাণিত হয়েছে। সপ্তাহে ন্যূনতম পাঁচ ঘন্টা পাঠাভ্যাসের এমনই এক গোপন কৌশল জীবনে প্রয়োগ করেছেন বিশ্বেসেরা নির্বাহীরা, যাকে বলা হয় 'ফাইভ আওয়ার রুল'।
বিল গেটস, ইলন মাস্ক ও জ্যাক মা'র মতো দূরদ্রষ্টা উদ্যোক্তারা সবকিছু করার ক্ষেত্রেই এ নীতি মেনে চলেন, যা তাদের অভূতপূর্ব সফলতা এনে দিয়েছে।
তবে এ নিয়মের উদ্ভাবক ছিলেন ১৮ শতকের বিখ্যাত মার্কিন উদ্যোক্তা, বিজ্জানী, লেখক, রাজনীতিবিদ, প্রকাশক ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। দিনে অন্তত এক ঘণ্টা তিনি বই পড়ে নতুন কিছু শেখায় ব্যয় করতেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ফ্রাঙ্কলিন একান্ত কিছু সময় নিয়ে আত্ম-বিশ্লেষণে মগ্ন থাকতেন, তিনি স্ব-উন্নতির জন্য নানান রকম পরীক্ষাও করেছেন।
কিন্তু, সব রকম বিচার বিশ্লেষণ শেষে ১৭৫৮ সালে তাঁর সেরা উপলদ্ধি – "জ্ঞান সাধনায় সময় বিনিয়োগই হলো সুদে-আসলে লাভবান হওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়।"
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলে দিনের অনেকটা সময় বাড়তি পাওয়া যায়। ফ্রাঙ্কলিন একাজটি করতেন বই পড়া ও আত্ম-বিশ্লেষণের জন্য সময় পেতে। আত্ম-বিশ্লেষণ লেখালেখি করেও করা যায়, এসময় জীবনের অনেক প্রশ্নই নিজের সামনে রাখতেন ফ্রাঙ্কলিন, আর খুঁজতেন সেসবের সদুত্তর। বিকেল বেলাতেও চলতো এই নিয়মের প্রয়োগ। বই পড়ে ও আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে যেসব নতুন আইডিয়া পেতেন সেগুলোই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় কাজে লাগাতেন। এভাবে তিনি এমন একজন সফল বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন, যিনি পরবর্তীকালে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছেন। হয়েছিলেন সফল উদ্যোক্তাদেরও একজন।
অধিকাংশ সময়েই আমাদের জ্ঞান সংকট আর্থিক অস্বচ্ছলতারও কারণ হয়। আজকের পৃথিবীর প্রতিযোগিতামূলক পেশাগত জীবনে যার প্রভাব সুস্পষ্ট। জ্ঞান চর্চায় উৎসাহ দিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে এ দুই সংকট সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে 'ইমপ্যাক্ট' নামের একটি এক বাণিজ্যিক সংস্থা চালু করেন মাইকেল সিমন্স। বলাই বাহুল্য তাঁর প্রেরণার উৎস ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন স্বয়ং।
সিমন্সের মতে, "দীর্ঘদিন ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক নিষ্ক্রিয়তার ফল হয় দীর্ঘসময় ধরে শরীরচর্চা না করা, ঠিকমতো পানাহার না করা ও পর্যাপ্ত পরিমাণ না ঘুমানোর মতোই মারাত্মক। সপ্তাহে ন্যূনতম পাঁচ ঘণ্টা জ্ঞান চর্চায় ব্যয় না করাকেও, ঠিক একইরকম ভাবে ২১ শতকে ধূমপানের মতো ক্ষতিকর বদভ্যাসের সাথে তুলনা করা যায়।"
২১ শতকে সফল উদ্যোগের পেছনে জ্ঞানই হচ্ছে মূল শক্তি। উদ্যোক্তার জ্ঞান যতো বাড়ে, ততোই বাড়ে সৃজনশীল চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। তাই বিশ্বসেরা উদ্যোক্তারা সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা বই পড়ার পেছনে ব্যয় করবেন- এটাই স্বাভাবিক।
সেরা ধনীদের মধ্যে সবচেয়ে একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে খ্যাতি আছে মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও বছরে তিনি অন্তত ৫০টি নতুন বই পড়ে শেষ করেন।
২০১৬ সালে গণমাধ্যম কোয়ার্টজ'কে দেওয়া সাক্ষাতকারে বিল বলেছিলেন, পড়াশোনার নিয়মিত অভ্যাস কাজটি আরও সহজ করে তোলে।
"আপনি যদি যথেষ্ট পরিমাণ পড়ুয়া হন, তাহলে দেখবেন কিছু বইয়ের কোন কোন বিষয়বস্তু অন্যগুলোর মতোই। ফলে পূর্বজ্ঞান থেকে সাহায্য পাবেন। এভাবে আপনার যদি বড় পরিসরে জ্ঞানের কাঠামো গড়ে ওঠে, তাহলে এক সময় সবকিছু মিলিয়ে দেখা বা বিশ্লেষণের ক্ষমতাও অর্জন করবেন।"
বিল গেটস একা নন, পুঁজিবাজারের শীর্ষ ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেটও কম যান না। দিনে ছয় ঘণ্টা বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকেন সর্বকালের সেরা বিনিয়োগকারী খ্যাত বাফেট। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্করা দিনে গড়ে ২০ মিনিটেরও কম সময় পড়ার পেছনে ব্যয় করেন।
বাফেটের মতে, "এভাবে আমি দিনে ৫০০ পাতা! পড়ে ফেলি। ফলে চক্রবৃদ্ধি সুদের মতোই জ্ঞানও বাড়তে থাকে। চাইলে আপনারা যে কেউ এই অভ্যাস রপ্ত করতে পারেন, কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি অধিকাংশই তা করবেন না।"
ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রেও জ্ঞানের চাহিদা বাড়বে বৈ কমবে না।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) আভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ কর্মচ্যুত হবেন প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষ। আর ২০২২ সাল নাগাদ অন্তত ৫৪ শতাংশ কর্মীর নতুন দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন হবে।
২০২০ সালের শেষদিকে ডব্লিউইএফ- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া জাহিদি বলেছেন, "ভবিষ্যতে মানব সম্পদের উন্নয়নে অধিক বিনিয়োগকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হবে।"
তাই নিজের দক্ষতা সমৃদ্ধকরণের এটাই সবচেয়ে আদর্শ সময়, এজন্য জ্ঞান ভাণ্ডার বাড়ানো শুরু করতে পারেন এখন থেকেই।
ফাইভ আওয়ার রুল যেভাবে প্রয়োগ করবেন:
#দিনে এক ঘণ্টা সময় পড়ার পেছনে ব্যয় করুন:
নতুন দক্ষতা চর্চা ও পাঠাভ্যাসে দিনে অন্তত একঘণ্টা ব্যয় করার মতোই সহজ এ কৌশল।
কাজ শুরুর পর দিনের অধিকাংশ সময় ব্যস্ততার মধ্যেই কাটে, এজন্য ফ্রাঙ্কলিন সকাল সকাল উঠে আগে একঘণ্টা পড়ে নিতেন। তারপর অন্য কাজ শুরু করতেন।
কর্মক্ষেত্রে যেতে যারা যানবাহন ব্যবহার করেন, তারা চলার পথে অডিও বুক শুনতে পারেন, বা বই পড়তে পারেন। অথবা দিনের কাজ শুরুর আগের ও শেষের আধাঘণ্টা করে ব্যয় করতে পারেন পড়াশোনায়।
ধীরে ধীরে এই ছোট পরিসরের চর্চা বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডারে রূপ নেবে।
#পড়ার জন্য সময় দিন:
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও দায়িত্বভার তাড়িত ব্যক্তি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউজে থাকাকালীন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাও অন্তত একঘণ্টা পড়তে ব্যয় করতেন। গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তের দায়ভার কাঁধে নিয়ে তিনিই যদি পারেন, তাহলে যেকোন ব্যক্তির পক্ষেই অন্য কাজ না করে অখণ্ড মনোযোগে পড়ার জন্য একঘণ্টা সময় দেওয়া সম্ভব।
ওবামা বলেন, "অন্য সকল প্রকার দক্ষতা অর্জনের দুয়ার হলো পাঠাভ্যাস। দুর্বোধ্য শব্দ অনুধাবন থেকে শুরু করে ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো বহুবিধ ঘটনাগুলো পড়লে তা আমাদের মেধাকে শানিত করে তোলে।"
পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শনে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কাল্পনিক কাহিনীর চাইতে প্রামাণিক গ্রন্থ বা বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা বই আত্মজীবনী ও সংবাদ প্রতিবেদন পড়তে বেশি সময় ব্যয় করেন।
#সময় নিন আত্ম-উপলদ্ধির জন্য:
পড়ে নতুন যা শিখলেন তাঁর সঙ্গে নিজের বিশ্লেষণকে মিলিয়ে লেখার চর্চাও গড়ে তুলুন। লেখালেখির এই চর্চা জ্ঞানের শিকড়কে দৃঢ় করে, আবার প্রতিটি শব্দ লেখার সময় নতুন নতুন ভাবনারও খোরাক যোগায়।
বিখ্যাত পোশাক ব্র্যান্ড স্প্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা সাড়া ব্লেকলি ও ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রিচার্ড ব্র্যানসনের মতো ব্যক্তিত্বরা কিন্তু নতুন অর্জিত জ্ঞান চর্চা, নিজস্ব ভাবনা ও ভুল সংশোধনের উপায় হিসেবে নিয়মিত লেখালেখি করেন। ইতিহাসের বিখ্যাত অ্যারিস্টোটল ওনাসিস ও ফ্রিদা কাহলোর মতো মহান ব্যক্তিদেরও ছিল এ অভ্যাস।
#পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠার পর সেগুলো প্রয়োগ ও ভুল সংশোধনের জন্য বাস্তবিক পরীক্ষানিরীক্ষার মতো প্রক্রিয়া তৈরি করুন।
এর ফলে হাতে-কলমেই দেখতে পারবেন, কোনটি কার্যকর আর কোনটি নয়। জ্ঞানের প্রয়োগ ও পরীক্ষা- ফাইভ আওয়ার রুলের অন্যতম শর্ত।
এই চর্চা আপনাকে ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দিয়ে ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে অগ্রপথিক হিসেবে গড়ে তুলবে।
আপনার সাফল্য বা ব্যর্থতা ছোট ছোট এই চর্চাগুলো রপ্ত করা বা না করার মাধ্যমেও নির্ধারিত হতে পারে।