পথের খাবারের জন্য ঢাকার যে জায়গাগুলো এখন বিখ্যাত
করোনাকালের দেড়–দুই বছর বাদ দিলে আবারও বাইরে গিয়ে খাওয়ার ধারা এখন যথেষ্টই বেগবান। ঢাকা শহরের দেশি–বিদেশি নানা ঘরানার রেস্তোরাঁর পাশাপাশি পথের ধারের ঠেলা বা ভ্যানগাড়ির অস্থায়ী খাবারের দোকানগুলোর প্রতিও ভোজনরসিকদের আকর্ষণ দেখা যাচ্ছে বেশ। বিভিন্ন এলাকায় সড়কের এক পাশে বা কোনো বাজারের সামনের চত্বরে বিকেল থেকে জমজমাট খাবারের সব দোকান, এবারের শীতসন্ধ্যায় ঢাকার
বিভিন্ন স্থানে এ দৃশ্য চলতি পথেই দেখা যাচ্ছে।
হাঁসের মাংস আর ৩০০ ফিট সড়ক—যেন দুজন দুজনার। রাজধানী থেকে পূর্বাচলে যাওয়ার যে দৃষ্টিনন্দন এক্সপ্রেসওয়ে, সেটার দুপাশে অসংখ্য দোকানে প্রতি সন্ধ্যায় ভিড় জমান অনেক মানুষ। কুড়িল থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগোলে দুটি আন্ডারপাস পার হওয়ার পর, তৃতীয় আন্ডারপাসের ওপর দিয়ে ডানে মোড় নিয়ে নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পেছনে বালু নদের তীরঘেঁষা অসংখ্য দোকান, ছোট–বড়। শ দুয়েক তো হবেই। জায়গাটা নীলা মার্কেট হিসেবেই পরিচিত।
২৪ জানুয়ারি শীতের রাত নয়টার দিকে নীলা মার্কেটে গিয়ে দেখা হলো সাইদুর রহমান–সিরিয়া বেগম দম্পতির সঙ্গে। দুই সন্তানসহ তাঁরা এসেছেন উত্তরা থেকে। সাইদুর রহমান বললেন, ‘সপ্তাহে একবার–দুবার আসা হয় এখানে। বেশ ভালো লাগে।’ কী খান এসে? ‘হাঁসের মাংস আর চাপড়ি (চাপড়া নামেও ডাকা হয়) রুটি।’ এ জায়গার ট্রেডমার্ক খাবার এটা। এর বাইরে গরু আর মুরগিভুনাও আছে প্রায় প্রতিটি দোকানে। চাপড়ির পাশাপাশি রুমালি রুটিও মিলবে প্রতিটি দোকানে। এখানে সব দোকানেই রান্না করেন নারীরা। ৯ বছর ধরে একটি দোকানে রান্না করছেন পাখি বেগম। তাঁর সামনের কড়াইয়ে তখন হাঁসের মাংস গরম হচ্ছে। পাখি বেগম জানালেন, এখানে দেশি পাতিহাঁসের ভুনাই বিক্রি হয় বেশি। স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করেন সবাই। শুক্রবার বা বিশেষ কোনো ছুটির দিনে ভিড় বেশি। নীলা মার্কেটে ঢোকার মুখে কয়েকটা রেস্তোরাঁ খোলা থাকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই। পূর্বাচল মুসা মীর জামাই–বউ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের দুই রাঁধুনি মনোয়ারা বেগম ও সুলতানা বেগম জানালেন, হরেক রকম ভর্তাও বিক্রি হয়। আছে মুরগি ও মাছের বারবিকিউ। এসব দোকানের আশপাশে আছে মিষ্টির দোকান। গরম মিষ্টির জন্যও বিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মধ্যে পড়া পূর্বাচলের এই এলাকা।
৩০০ ফিট সড়কের বাঁ দিকেও এমন খাবারের অনেক আয়োজন মিলবে। পূর্বাচল ক্লাব পেরিয়ে শহীদ ময়েজ উদ্দিন চত্বর ঘিরে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। সবই অস্থায়ী। আরও কিছুটা এগোলে ফারুক মার্কেট এলাকায়ও রয়েছে হাঁসের মাংস খাওয়ার আয়োজন।
হাঁসভুনার যে ধারা, তা ঢাকার কেন্দ্রেও ঢুকে পড়েছে। শাহবাগের একটু আগে পরীবাগের উল্টো দিকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে পদচারী–সেতুর বাঁ দিকে ইস্কাটন গার্ডেন রোড। বিটিসিএল ভবনের সামনের চত্বরটা বিকেল পাঁচটার পর থেকেই ভরে যায় বাইক আর গাড়িতে। আলোকিত ভ্যানের আয়োজন দেখে কারণটাও বোঝা যায়। এখানে কাবাবওয়ালায় পাওয়া গেল হাঁসভুনা, বট (গরুর ভুঁড়ি) ভুনা, মুরগিভুনা। হাঁসের জনপ্রিয়তা এখানেও। এখানে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে মানুষের আনাগোনা, খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা। সরকারি চাকুরে রাকিবুল ইসলাম এসেছেন সস্ত্রীক। বললেন, উৎসব উৎসব আমেজ আছে একটা। তাই ভালো লাগছে।
ইস্কাটন গার্ডেন রোডের এ জায়গায় বেশ কটি ভ্যান আছে—ওপরে লেখা লাইভ পিৎজা। চোখের সামনেই পিৎজা বানিয়ে দিচ্ছেন দোকানিরা। তেলাপিয়া, কোরাল, সুরমা, টুনা, কাঁকড়ার বারবিকিউও এখানে মেলে বেশ কটা দোকানে। বন্ধুদের সঙ্গে বাইক নিয়ে প্রথমবারের মতো খেতে এসেছেন তুহিন ও নিলয়। বললেন, খুব ভালো লাগছে। আড্ডা ও খাওয়া একসঙ্গে চলছে।
দু–তিনটি ভ্যানে মোমোর আয়োজনও রয়েছে ইস্কাটন গার্ডেন রোডের এই খাবার চত্বরে। পথের খাবারের ধারায় মোমোর জনপ্রিয়তাও কম নয়। মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের সামনের রাস্তায় এই ধারা যেন আরও উজ্জ্বল। বছর দুই আগে এই স্থান জমে উঠেছিল সিঙ্গাপুর জুসের কারণে। এখন জুসের দোকান বেড়েছে আর ফুটপাতের ধারে বিকেল থেকেই বসে যাচ্ছে বার্গার, মোমো, চাপ, পানিপুরি, স্যুপের সব আয়োজন।
তিন দশক আগে মোহাম্মদপুরের সলিমউল্লাহ রোড শুধু সেলিমের কাবাবঘরের জন্যই খ্যাত ছিল। ছোট ছোট সুস্বাদু কাবাব। সলিমউল্লাহ রোডে সেলিমের কাবাবঘর এখন দুটি। সড়কজুড়েই মোমো, চিকেন–কর্ন স্যুপ, মোমো স্যুপ আর রকমারি চায়ের পসরা, ভ্যানে ভ্যানে। কর্মদিবসগুলোয়ও রাত ১১টা পর্যন্ত ভিড় নানা বয়সী মানুষের।
মোহাম্মদপুর–শ্যামলী পর্যন্ত রিং রোডে জাপান গার্ডেন সিটির সামনের রাস্তাও জমে ওঠে পথের খাবারে। এ সড়কের তিনটি স্থানে রয়েছে পথের খাবারের পসরা। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের সামনের রাস্তা ঘেঁষে চাপের আয়োজন বেশ। তবে এগুলো এখন রীতিমতো রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে।
ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্রসরোবর ঘিরেও রয়েছে খাবার–আড্ডার নানা অনুষঙ্গ। এখন শুধু চটপটি, ফুচকা নয়; মাংসের চাপ, বার্গার, ফ্রায়েড চিকেনের আয়োজন নিয়মিত।
পথের ধারের খাবারের মেনুতে পরিবর্তন দেখা যায় বছর–দুবছর বাদে। চটপটি–ফুচকাকে ছাপিয়ে কোনো কোনো খাবার কোনো কোনো বছর ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শীতের জবুথবু সন্ধ্যায় একটু বেড়িয়ে আসা, উৎসব উৎসব আমেজে গরম–ঝাল হাঁসভুনা জীবনীশক্তি একটু হলেও যে বাড়ায়, তা বোঝা যায় খাবারের ছোট–বড় প্রতিটি জায়গা দেখলে।