জয় পকেট ডিকশনারির উত্থান ও অনিবার্য পতনের গল্প

জয় পকেট ডিকশনারির উত্থান ও অনিবার্য পতনের গল্প

জয় পকেট ডিকশনারির আদি প্রকাশক ছিলেন এসকে আহমেদ। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জয় বুকস ইন্টারন্যাশনাল থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে অভিধানটি। ১৯৮৫ সালে ডিকশনারিটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১৯৯০ সালে আরেকটি সংস্করণ। তবে ২০২৩ সালে এটি পুনর্মুদ্রণ করা হয়।

সেদিন বিকেলে পুরান পল্টনের ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। একটা দোকানের সামনে থমকে দাঁড়ালাম, চোখ আটকে গেল লাল রংয়ের মলাটটার ওপর। ছোট্ট জয় পকেট ডিকশনারিটা অন্য বইগুলোর ফাঁক দিয়ে দিব্যি আলাদা হয়ে ধরা পড়ছে।


দেখামাত্রই চিনতে এক মুহূর্তও দেরি হলো না। ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে একটা সবসময় নিজের সঙ্গে থাকত। নিয়মিত নতুন নতুন শব্দ পড়তাম, প্রিয় অনেক শব্দের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এ ডিকশনারি থেকেই।


একটা সময় দেশের সব জায়গায় জয় পকেট ডিকশনারি পাওয়া যেত। স্কুলপড়ুয়া, কলেজেওঠা শিক্ষার্থীরা ইংরেজিটা একটু ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য সবসময় নিজেদের সঙ্গে একটা জয় ডিকশনারি রাখত।


জয় ডিকশনারির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ভারতীয় এটি দেব-এর পকেট ডিকশনারি। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের অভিধান ব্যবসার তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে ছিল জয়।


তবে ওয়েবসাইট ও পরে মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশনই জয় পকেট ডিকশনারির জন্য কাল হলো। মোবাইলে ডিকশনারি অ্যাপ্লিকেশনই কাগজের এ অভিধানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকলো। কিন্তু নস্টালজিয়ার উপাদান হওয়ার আগে জয় পকেট ডিকশনারি দারুণ ব্যবসা করেছিল।


উত্থান-পতন

১৯৯০ থেকে ২০০০ সালে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল জয় পকেট ডিকশনারি। তখন এর এক একটি ক্যাটাগরিই মাসে ১০ হাজার কপি বিক্রি হতো। মাঝেমধ্যে পহেলা বৈশাখের মতো বিভিন্ন উৎসবের সময়ে ছাড় দেওয়া হলে বিক্রি আরও বাড়ত।


প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর কর্ণধার শহীদ হাসান তরফদার বলেন, 'আমরা একত্রে চেষ্টা করতাম ব্যবসা বাড়াতে। ডিকশনারির বাঁধাই ও মলাটও আকর্ষণীয় ছিল।'


ওই সময় পকেট ডিকশনারি, লার্নার'স ডিকশনারি, অ্যাডভান্সড লার্নার'স ডিকশনারি, জয় কনসাইজ ডিকশনারি ইত্যাদি বিভিন্ন ধাঁচের অভিধান ছিল। প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানটি সিক্স-ইন-ওয়ান, থ্রি-ইন-ওয়ান-এর মতো ইংরেজি শেখার বইও বের করত। আর ছিল কিছু ধর্মীয় বই।


১৯৮৮ সালে ঢাকা শহরে জয় ডিকশনারির একমাত্র এজেন্ট হন শহীদ।


২০০৬ সালে তিনি এর কপিরাইট কেনেন। ততদিনে শহুরে বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, এবং জেলা শহরগুলোর সাবইবার ক্যাফেতে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে, যদিও মানুষজন তখনো তা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। সবমিলিয়ে ওই সময়ও তুমুল জনপ্রিয় ছিল জয় ডিকশনারি।


শহীদ জানান, জয় পকেট ডিকশনারি এবং মাঝারি আকারের জয় অ্যাডভান্সড পকেট ডিকশনারি একই গতিতে বিক্রি হতো। অন্য জয় অভিধানগুলোর আলাদা আলাদা সংস্করণ ছিল — ইংলিশ-টু-বাংলা, বাংলা-টু-ইংলিশ ও বাংলা-টু-বাংলা। তবে এগুলোর মধ্যে আজকের দিনেও সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি–বাংলা অভিধানটি।


জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর জয় ডিকশনারির রমরমা বিক্রি ছিল প্রায় ১০ বছর ধরে।


কিন্তু ধীরে ধীরে বিক্রি পড়তে থাকে। ২০১৫–১৬ সালের দিকে এবং মোবাইল অ্যাপ জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে এ অভিধানের বিক্রি দ্রুত কমে আসে। ২০২৩ সালে এসে এখন একটি ডিকশনারির মাত্র ৫০০ কপি সারা বছরে বিক্রি হয় বলে জানান শহীদ।


২০০৬ সালে একটি জয় পকেট ডিকশনারির দাম ছিল ২০ টাকার মতো। এখন পাইকারি হারে প্রতিটির দাম ৪০ টাকা।


প্রতি বছর শহীদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ হাজার কপির মতো জয় ডিকশনারি ছাপায়। ১৯৮৫ সালে ডিকশনারিটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১৯৯০ সালে আরেকটি সংস্করণ। তবে ২০২৩ সালে এটি পুনর্মুদ্রণ করা হয়।


এছাড়া গত এক দশকে অভিধানটির সম্পাদকেরা ১০০-এর বেশি শব্দ নতুন করে যুক্ত করেছেন বলেও জানান শহীদ।


জয় ডিকশনারির উত্থান

জয় পকেট ডিকশনারির আদি প্রকাশক ছিলেন এসকে আহমেদ। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জয় বুকস ইন্টারন্যাশনাল থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে অভিধানটি।


'তিনি [এসকে আহমেদ] ডিকশনারিগুলো প্রকাশ করতেন আর সেগুলো সারাদেশে আমি বিক্রি করতাম,' বলেন ৬৭ বছর বয়সি শহীদ।


'২০০০-এর দশকের কোনো এক পর্যায়ে এসকে আহমেদ বইয়ের ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন আমি যেন তার কোম্পানিটি কিনে নিই,' স্মৃতিচারণা করেন শহীদ। '২০০৬ সালেই ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাব ছিল সেটা।'


'তিনি আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়, আর আমি বাজার ও জয় ডিকশনারি দুটোরই খুঁটিনাটি জানতাম,' শহীদ বলেন।


ডিকশনারিটি কেনার তার আরও একটি কারণ ছিল। ১৯৮০-এর দশকে শহীদ তার জ্ঞানকোষ স্টেশনারি দোকানটি চালু করেছিলেন। মূলত পাঠ্যবইয়ের এ দোকানটি গ্রাহকের মাঝে জনপ্রিয় হয়েছিল এ ডিকশনারিটির কল্যাণেই।


'[আর] অভিধানটির মান সবসময় ভালো ছিল,' শহীদ বলেন। তিনি জানান, অনেক প্রকাশকই পরে ডিকশনারি প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু জয়-এর মতো সাফল্য কেউই পাননি।


নিউ মার্কেট এলাকায় এসকে আহমেদের একটা ছাপাখান ছিল। 'এ লোকের উদ্ভাবনী কাজ করার এলেম ছিল। আমদানি করা ভারতীয় অভিধান বাজারে ধাক্কা খেয়েছিল জয় পকেট ডিকশনারির মানের কারণে,' বলেন শহীদ।


ওই সময় এটি দেব-এর মতো কিছু ভারতীয় অভিধান বাজারে মিলত। কিন্তু জয় ডিকশনারির যাত্রা শুরুর পর এসব অভিধানের আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।


তবে বইয়ের মতো ঢাউস সাইজের সংসদ বাংলা অভিধান নিয়মিত বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করেছিল। এখনো এটি পাওয়া যায়।


জয়-এর 'পরাজয়'

পকেট-সাইজ ডিকশনারি তৈরি করাটা কঠিন। একসময় যারা এ ধরনের ডিকশনারি বাঁধাই করতেন, তারা আর এ কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। শহীদ আরও বলেন, কাগজের দামেরও একটা বাধা আছে। লাভও উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে।


২০১৮ সালে এক রিম ডাবল-ডেমি কাগজের দাম ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এখন এক রিমের দাম ১,৭০০ থেকে ১,৮০০ টাকা। বাঁধাইকারীদের মজুরিও আগের চেয়ে বেড়েছে।


'আগে যে লাভ করতম, তার অর্ধেকও হয়না এখন,' শহীদ বলেন।


কিন্তু জয় ডিকশনারির হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ কাগুজে অভিধানে মানুষের আগ্রহ বিলীন হয়ে যাওয়া। 'আগে মানুষ আগ্রহ নিয়ে ডিকশনারি কিনত। এখন আর সে আগ্রহ নেই,' বলেন শহীদ।


বর্তমানে শহীদের প্রকাশনী জয় পকেট ডিকশনারি (ইংরেজি–বাংলা), জয় পকেট ডিকশনারি (বাংলা–ইংরেজি), জয় নব অভিধান, জয় অ্যাডভান্সড পকেট ডিকশনারি (বাংলা–ইংরেজি), জয় স্ট্যান্ডার্ড পকেট ডিকশনারি, জয় শব্দ সঞ্চয়িতা বিক্রি করে।


জ্ঞানকোষ প্রকাশনী এ বছর বইয়ের আকৃতির জয় অ্যাডভান্সড লার্নার্স ডিকশনারি বের করার উদ্যোগ নিয়েছে।


জয় ডিকশনারির কোনো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে শহীদ বলেন, 'আমার ছেলে এখন ব্যবসায় ঢুকেছে, এ ব্যাপারে সে সিদ্ধান্ত নেবে। এরকম কিছু একটা পরিকল্পনাও আছে তার।'


এখন পর্যন্ত জয় ডিকশনারির লোগো ও রং পালটায়নি জ্ঞানকোষ প্রকাশনী। কেবল প্রকাশনার জায়গায় নিজেদের নাম যুক্ত করেছে। তারা এমনকি সাবেক প্রকাশনীর নামও রেখে দিয়েছে। এসকে আহমেদ বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ অধ্যাপক ও হেডমাস্টারদের সহযোগে অভিধানটি সম্পাদনা করেছিলেন।


'আমি নামটা রেখে দিয়েছি কারণ এটা সৌজন্য ও সম্মানের বিষয়,' বলেন শহীদ।Source: tbsnews.net