আইজিপি বেনজিরের নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি; সততার প্রশ্নে বড় উদ্বেগ
মো: শাহ আলম: আইজিপি বেনজির আহমেদ, একসময় একজন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) প্রধান ছিলেন। তার বক্তৃতাগুলোতে পুলিশ সদস্যদের সততার ওপর গুরুত্বারোপ করা হত। কিন্তু তার ক্যারিয়ার একটি নাটকীয় মোড় নেয় যখন তার বিশাল দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পায়। এই চমকপ্রদ সংবাদটি বিভিন্ন পত্রিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনসম্মুখে আসে, যা জনগণ এবং অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদের হতবাক করে দেয়। এর ফলে সৃষ্ট কেলেঙ্কারি ও জনমনে ক্ষোভের মাঝে বেনজির এবং তার পরিবার দেশ ত্যাগ করে, পিছনে রেখে যান একটি কলঙ্কিত ঐতিহ্য এবং মনোবলহীন পুলিশ বাহিনী, যা তার কর্মকাণ্ডের ফলাফল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
৩১ মে, ডেইলি প্রথম আলো জানায় যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেনজির আহমেদ এবং তার পরিবারের নামে উল্লেখযোগ্য সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এই সম্পদগুলোর মধ্যে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর এবং ঢাকায় ৬২১ বিঘা জমি; ঢাকার গুলশান এলাকায় চারটি ফ্ল্যাট; ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট; ১৯টি কোম্পানির শেয়ার; শেয়ার ট্রেডিংয়ের জন্য তিনটি বেনেফিসিয়ারি ওনার (বিও) অ্যাকাউন্ট; এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অন্তর্ভুক্ত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, আদালত এই সম্পদগুলোর জব্দের নির্দেশ দেয়। আইন প্রয়োগকারী সূত্র অনুযায়ী, বেনজির আহমেদ ৪ মে দেশ ত্যাগ করেন, ঠিক আদালতের আদেশের আগে। বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে যে বেনজির আহমেদ বর্তমানে সিঙ্গাপুরে আছেন। তবে, তিনি সত্যিই সিঙ্গাপুরে আছেন নাকি অন্য কোথাও, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বেনজির আহমেদ ১৫ এপ্রিল ২০২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে, তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার এবং র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর ছিল, যার মধ্যে বেনজির আহমেদও ছিলেন। নিষেধাজ্ঞার সময়, বেনজির আহমেদ আইজিপি পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, বেনজির আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন, যেখানে তিনি তার প্রভাব ও ক্ষমতা বজায় রাখেন, যা বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত, তিনি যদি সততার পথে থাকতেন, তবে তিনি আজ এই অসম্মানজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতেন না।
১ জুন, ২০২৪ তারিখে, ডেইলি দেশ রূপান্তর শিরোনাম করে "বেনজির আহমেদ সিঙ্গাপুরে স্থায়ী আমানত থেকে টাকা তুলে নেন"। বেনজির আহমেদ গত দেড় মাসে তার স্থায়ী আমানত থেকে অর্থ তুলে নিয়েছেন। অনুমান করা হয় যে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ১৫টি অ্যাকাউন্টে ছিল, যা আর নেই।
আইজিপি বেনজিরের অভিযোগিত দুর্নীতির সাম্প্রতিক প্রকাশ "ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিগ্রস্ত করে" এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে। এই ভয়াবহ ঘটনা অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের সততার গুরুত্ব সম্পর্কে সতর্ক করে। একসময় অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাদের সততা ও নিষ্ঠার জন্য পরিচিত ছিলেন, কিন্তু এই ধরনের উদাহরণ এখন বিরল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি দুর্নীতি প্রতিরোধে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনে শক্তিশালী পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
আজকের বাংলাদেশে, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ পুলিশ কর্মকর্তারা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে। সততা ও ন্যায়পরায়ণতা এখন সোনার হরিণের মতোই দুষ্প্রাপ্য। তবে, অনেক সৎ পুলিশ কর্মকর্তা এখনও উদাহরণমূলক জীবন যাপন করেন। আমরা তাদের ভুলে যেতে পারি না এবং তাদের সততা তুলে ধরা উচিত। দুর্নীতিগ্রস্ত একজন ব্যক্তির নেতিবাচক উদাহরণ তুলে ধরার পরিবর্তে, আমরা তার চূড়ান্ত পতনকে সতর্কতামূলক গল্প হিসেবে মনে রাখি।
বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় সততা ও মর্যাদার গুরুত্ব:-
আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় পেশাগত আচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সততা ও মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সততার রক্ষক হিসেবে, বিশেষ করে আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা গভীর দায়িত্ব বহন করে। পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) মতো একটি প্রভাবশালী পদে থাকা ব্যক্তির উচিত দুর্নীতিতে জড়িত না হয়ে সততার উদাহরণ স্থাপন করা, যাতে অন্যরা অনুসরণ করতে পারে। অবসর নেওয়ার পরেও, তাদের সম্মানজনক উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত এবং তাদের ঐতিহ্য ও সমাজের মঙ্গল ধ্বংস করে এমন দুর্নীতিপ্রবণ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।
সততা: ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ:-
পবিত্র কোরআন, সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১১০ এ বলা হয়েছে, "তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, যা মানবজাতির জন্য উদাহরণ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহতে বিশ্বাস রাখো।" তেমনিভাবে, আয়াত ১০৪ এ বলা হয়েছে, "তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকুক, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। তারাই সফল হবে।"
আমর বিল-মারুফ ওয়া নাহি আনিল-মুনকার” অর্থ হলো সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা। সৎ কাজ করা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা ব্যক্তিগত দায়িত্ব, এবং অন্যদের সৎ কাজ করতে উৎসাহিত করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা একটি পবিত্র দায়িত্ব।
পবিত্র কোরআন, সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১১০ এ বলা হয়েছে, "তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, যা মানবজাতির জন্য উদাহরণ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহতে বিশ্বাস রাখো।" তেমনিভাবে, আয়াত ১০৪ এ বলা হয়েছে, "তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকুক, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। তারাই সফল হবে।"
হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, "তুমি যদি কোনো মন্দ কাজ দেখতে পাও, তবে তা হাতে পরিবর্তন করো; যদি না পারো, তাহলে মুখে বলো; যদি না পারো, তাহলে অন্তরে ঘৃণা করো, আর এটা হলো সবচেয়ে দুর্বল ঈমান।"
উপসংহার:-
কোরআনের একটি শিক্ষার আলোকে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায় যখন তিনি তার সাহাবাদের মধ্যে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ন্যায্যভাবে বিতরণ করছিলেন। কিছু লোক হয়তো ধারণা করতে পারে যে একজন মানব হিসেবে, নবী (সাঃ) কিছু সাহাবার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে সম্পদের অবিচার বণ্টন করতে পারেন। এই বিষয়ে কোরআনের সূরা আল-ইমরান (৩:১৬১) আয়াতে বলা হয়েছে: “(কোন) নবীর পক্ষেই (কোন বস্তুর) খেয়ানত করা সম্ভব নয়; (হাঁ মানুষের মধ্যে) কেউ যদি কিছু খেয়ানত করে তাহলে কেয়ামতের দিন সে বেক্তিকে তার (খেয়ানতের) সে বস্তু সহ (আল্লাহ্র দরবারে) হাযির হতে হবে, অতঃপর প্রত্যেকেই তার অর্জিত (ভালো মন্দের) পাওনা সঠিকভাবে আদায় করে দেয়া হবে, (সেদিন) তাদের কারও ওপর অবিচার করা হবে না”। এই আয়াতটি আমাদের শেখায় যে, নবীর পক্ষে অন্যায় করা বা কোনো ধরনের অসততা করা কখনোই সম্ভব নয়। আর যারা প্রতারণা করে, তারা তাদের কর্মের উপযুক্ত শাস্তি পাবে। এর মাধ্যমে আমরা শিক্ষা পাই যে, আমাদের উচিত সদা সর্বদা ন্যায্য ও সততার পথে চলা। আইজিপি বেনজির ক্ষমতার স্বাদ ও আবার বড় ধরনের পুকুর চুরিও করেছেন যার ফল তাকে দুনিয়া এবং আখেরাতেও ভগ করতে হতে পারে।
অবশেষে, আমি বলতে চাই, যদি আইজিপি বেনজির দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালীন সততার পথ ধরে থাকতেন, তবে তাকে আজ জনসমক্ষে এত সমালোচনার মুখোমুখি হতে হতো না। সততা নিয়ে কথা বললেও তিনি নিজে দুর্নীতি এবং সরকারি সম্পদের অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে ব্যর্থ হন। এটি অন্য কর্মকর্তাদের জন্য সঠিক তদন্ত এবং একটি নজির হওয়া দরকার। যাতে করে আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়নিষ্ঠ শক্তিশালী পুলিশ প্রশাসন পাওয়ার আশা করছি।
মোঃ শাহ্ আলম
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক আইআইইউএম, মালয়েশিয়া।
(এটি সম্পুর্ন লেখকের নিজস্ব মতামত)