অস্তিত্ব সংকটে ‘চলনবিল’

অস্তিত্ব সংকটে ‘চলনবিল’

দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম জলাভূমি চলনবিল। প্রায় হাজার মাইলের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে এক সময়ে বছরের সব সময়ই থাকত পানির প্রবাহ। পানি প্রবাহের কারণে বিস্তীর্ণ এ বিলকে বলা হতো চলন্ত বিল, পরবর্তীতে যা চলন বিল নামে পরিচিতি পেয়েছে।


দেশের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ চলন বিল কালের বিবর্তনে হারিয়েছে তার জৌলুস। যুগে যুগে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে চলনবিল হারিয়ে ফেলছে তার চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য।


এখন শুধু বর্ষা মৌসুম ছাড়া বিস্তীর্ণ এ বিলে পানির প্রবাহ দেখা যায় না। বিলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়েই চলে ফসলের আবাদ।

প্রকৃতি নির্ভর জলাভূমি হলেও বছরের বেশিরভাগ সময় বিলে পানির প্রবাহ না থাকায় চাষাবাদের জন্য কৃষকদের নির্ভর করতে হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর। ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় চলনবিলের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।


এক সময়ে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল চলনবিল। বিভিন্ন স্টাডি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ১৯০৯ সালের রেলওয়ের জরিপে চলনবিলের দৈর্ঘ্য ছিল ১০৮৫ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৪০ সালের জরিপে চলনবিলের আয়তন দাড়ায় ৭০৫ বর্গ কিলোমিটারে। তিন যুগে চলনবিলের আয়তন কমে প্রায় ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে চলনবিলের আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩৭৫ বর্গ কিলোমিটারে। তবে বাংলাপিডিয়ার দেওয়া তথ্য মতে বর্তমানে চলনবিলের আয়তন কমে ১৬৮ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। গত এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলনবিলের আয়তন প্রতি বছর ১.৮৩ শতাংশ হারে কমছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ৩২টি নদী, ৯৩টি বিল ও শতাধিক ক্যানেলের সমন্বয়ে চলনবিলের প্রবাহ। তবে কালের বিবর্তনে দখল দূষণে বেশিরভাগ জলধারা হারিয়ে গেছে।

চলনবিলের জলধারাগুলো হারিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদের জন্য এবং ব্যবহারের জন্য চলনবিলের ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত চলনবিল

১৯১৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার চলনবিলের মধ্যে দিয়ে সিরাজগঞ্জের সাথে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রথম রেললাইন স্থাপন করে। এটিই চলনবিলের মধ্যে প্রথম উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য রেল লাইন স্থাপন করা হলেও এ রেল লাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে চলনবিলকে প্রথমবারের মতো বিভাজিত করা হয়। রেললাইন স্থাপনের ফলে চলনবিলের পানির প্রবাহ প্রথমবার বাঁধাগ্রস্ত হয়।

১৯৮০ সালে বাঘাবাড়ী থেকে তাড়াশ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের পর চলনবিলের পানি প্রবাহ আরও বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তথ্য থেকে জানা গেছে, ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে ২০০৯-১০ পর্যন্ত চলনবিল এলাকায় ১ হাজার ১৮৮ কিলোমিটার রাস্তা, ১১৩টি ব্রিজ, ৮৫৫টি কালভার্ট, ৯০টি গ্রোথ সেন্টার, ২১টি স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হয়েছে।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা পরিবেশবিদ মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০০৩ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বনপাড়া-হাটিকুমরুল হাইওয়ে নির্মাণ করার ফলে চলনবিল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহাসড়ক নির্মাণ হওয়ার পর এর সঙ্গে সংযোগের জন্য চলনবিলের মধ্য দিয়ে আরও অনেক রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এসব সড়ক নির্মাণ করা হলেও এর ফলে চলনবিলের জলধারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে দাবি করেন মিজানুর রহমান।

শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নই নয় বরং নানা ধরনের স্থাপনা অবাধে গড়ে তোলা হচ্ছে চলনবিলের মাঝ দিয়ে। এতে করে চলনবিলের পানির আধারগুলো ক্রমাগত নষ্ট হচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পানি প্রবাহের উৎসমুখ। প্রাকৃতিক পানির উৎস নষ্ট হলেও চলনবিলের মধ্যে অবাধে চলছে পুকুর খনন ফলে চলন বিলের প্রাকৃতিক পানির উৎস আরও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি।

মরে যাচ্ছে চলনবিলের নদী

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী চলনবিলের পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত আটটি নদী বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশেষ করে রাস্তাঘাট, স্থাপনা, স্লুইচ গেটের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলনবিলের ক্ষতিগ্রস্ত নদ-নদীর মধ্যে অন্যতম বড়াল নদী। ২০১৮ সালে জাতীয় নদী কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বড়াল নদীর ১৮ কিলোমিটার নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।

বড়াল নদী ৫০০ ফিট প্রশস্ত হলেও স্লুইচ গেট নির্মাণের কারণে নদীর মুখ ছোট হয়ে গেছে। নদীর তীর ঘেঁষে নানা স্থাপনা গড়ে ওঠায় ধীরে ধীরে নদী ছোট হয়ে আসছে। ১৯৮৫ সালে রাজশাহীর চারঘাটে স্লুইচ গেট নির্মাণ করার কারণে বড়াল নদীর প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। চলনবিলের প্রধান নদী বড়ালের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চলনবিলের অন্যান্য নদ নদীগুলোও ধীরে ধীরে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসির) সূত্র মতে চলনবিলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত ২১টি নদীতে পলি পড়ে নাব্যতা নষ্ট হয়ে গেছে।

বিএডিসির সূত্র মতে এক সময়ে এ অঞ্চলের ৭১টি ক্যানেল ও ৪১০ কিলোমিটার ড্রেনের মাধ্যমে এ তিন জেলার কৃষকদের চাষাবাদ সম্পন্ন হতো।

বর্তমানে প্রায় ৩৬৮ কিলোমিটার ড্রেন আর ৯০ শতাংশ ক্যানেলের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাষাবাদ নির্ভর করছে এ অঞ্চলের কৃষকের। ফলে চলনবিলের পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে।

চলনবিলের অন্তর্গত পাবনার চাটমোহর উপজেলার খলিশাগাড়ি বিলের কৃষক মো. সাইদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ৯০ এর দশকে প্রথম যখন বিলে শ্যালো টিউবওয়েল স্থাপন করেন তখন ১২ থেকে ১৩ ফিট গভীরে মেশিন স্থাপন করেই পানি তুলতে পেরেছেন তিনি।

বর্তমানে ৩২ ফিট নিচেও পানির লেয়ার পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি। প্রতি বছর প্রায় ১ থেকে ২ ফিট পর্যন্ত পানির স্তর নেমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

কয়েক বছর আগেও এক ঘণ্টা মেশিন চালিয়েই এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে পেরেছেন এখন এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে ২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগছে বলে জানান তিনি।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান বলেন চলনবিল এলাকায় প্রায় ৭ হাজার গভীর নলকূপ, ১ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল এবং ৭ থেকে ৮ লাখ সাবমার্সবল পাম্প দিয়ে ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় চলনবিলের ভু-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে।

হারিয়ে যাচ্ছে চলনবিলের মাছ 

বাংলাদেশের মিঠা পানির মাছের সবচেয়ে বড় উৎস চলনবিলে পানি প্রবাহ না থাকায় এখন মাছের উৎপাদন ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। গবেষকদের মতে গত কয়েক দশকে প্রায় ৮০ প্রজাতির দেশি মাছের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। চলনবিলে মাত্রাতিরিক্ত বিষের ব্যবহার, পানি প্রবাহের এলাকা কমে যাওয়া, মাছের প্রজনন ব্যাহত হওয়ায় বেশিরভাগ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে।

শুধু মাছের প্রজাতি হারিয়েই যায়নি মাছের উৎপাদনও কমে গেছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে ১৯৮২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলনবিল অঞ্চলের প্রায় ৫২ শতাংশ মৎস্যজীবী তাদের পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, গবেষণা লব্ধ এলাকায় ১৯৮২ সালে চলনবিলে দেশি মাছের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৬ হাজার ৯৯০ টন, ১৯৮৭ সালে মাছের উৎপাদন ছিল ২৪ হাজার ৩৬৬ টন, ১৯৯২ সালে মাছের উৎপাদন দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৭০০ টন, ১৯৯৭ সালে ১৫ হাজার ৪২১ টন, ২০০২ সালে ১২ হাজার ৪৬০ টন এবং ২০০৬ সালে মাছের উৎপাদন দাড়ায় ১২ হাজার ১১৭ টন।

জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাছের উৎপাদন কমেছে ১২ শতাংশ।

চলনবিলের প্রবীণ মৎস্যজীবী সুবল হালদার বলেন, এক সময়ে বিল থেকে মাছ ধরে নৌকায় করে পাড়ে নিয়ে আসা দায় হতো, অনেক সময় অতিরিক্ত মাছ বিলেই ফেলে দিয়ে আসতে হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন বার বার জাল ফেলেও মেলে না কাঙ্ক্ষিত মাছ। মাছের আকাল হওয়ায় আমরা মৎস্যজীবীরা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।




চলনবিলকে বাঁচাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, চলনিবিলকে বাঁচাতে হলে চলনবিলের নদ নদী, খাল, বিল আর ক্যানেলগুলোকে রক্ষা করতে হবে।

বিলের পানির আধারগুলো খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে যাতে চলনবিলের অন্তর্গত নদী, খাল, বিলে সারা বছর পানির প্রবাহ পাওয়া যায়। পানির প্রবাহ ছাড়া চলনবিলকে জীবন্ত করা সম্ভব নয়।

নাজমুল বলেন, চলনবিলের জলধারাগুলো হারিয়ে যাওয়ায় বিলের জীব বৈচিত্র্য বিপন্ন হতে বসেছে। গত কয়েক দশকে চলন বিলের তাপমাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া, সময়মত বৃষ্টিপাত না হওয়াসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণে চলনবিলের চিরাচরিত আবহাওয়া বদলে গেছে। ফলে বিলের কৃষি কার্যক্রমের চালচিত্রও পাল্টে গেছে। চলনবিলের বিপর্যয় রোধ করতে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানান এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।