হজ্জঃ আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও বিশ্ব মুসলিম'র মহাসম্মিলন
ইসলামের মৌলিক পাঁচটি রুকন এর মধ্যে হজ্ব অন্যতম একটি রুকন, স্তম্ভ বা খুঁটি। সালাত, সিয়াম এবং যাকাতের মতোই একটি ফরজ ইবাদত যা কেবল সামর্থ্যবানদের ক্ষেত্রে ফরজ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত (১) তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা। এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত বান্দা ও রাসূল (২) সালাত কায়েম করা (৩) যাকাত প্রদান করা (৪) হজ্জ করা (৫) সিয়াম পালন করা।
হজ্জ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো – ইচ্ছে করা, সংকল্প করা, পর্যবেক্ষণ করা।
মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্দিষ্ট সময়ে কাবা শরিফ এবং নির্দিষ্ট স্থান সমূহে তাওয়াফ ও জিয়ারত করাকে হজ্জ বলে।
হজ্জকে বলা যায় মানবতার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এই প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদ শুধু মাত্র পাঁচদিন। পাঁচদিনের এই প্রশিক্ষণ বিশ্ব মুসলিমের বাৎসরিক কর্মপরিকল্পনা। বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে যে বিভেদের দেয়াল। শুভ্রকায় ও কৃষ্ণকায় এর যে প্রভেদ। বর্ণবৈষম্য ও বংশকৌলীন্য'র প্রথাগত যে বীজ। পদ-পদবি ও অর্থনৈতিক অবস্থানগত যে পার্থক্য মানুষের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে হজ্জের মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব। হজ্জ শেখায় মানুষের একটাই পরিচয় আর তাহলো সে মানুষ। পৃথিবীর সব মানুষ একই রবের সৃষ্টি। এক পৃথিবীর আলো হাওয়ায় বেঁচে আছে সবাই। তাহলে কেন এতো বিভেদ? এক সারিতে হজ্জের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে ভুলে যাওয়া চেতনাকে শাণিত করতে হজ্জের ভূমিকা অপরিসীম।
পবিত্র বায়তুল্লাহ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে করা এ সফর ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এ সফরের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ। এ সফরে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, পার্থিব স্বার্থ থাকে না কোন মুমিনের অন্তরে। শুধু মহামহিম রবের সন্তুষ্টিই একান্ত কাম্য। জিলহজ্জ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত মক্কা, মিনা, আরাফা এবং মুযদালিফার ঐতিহাসিক স্থান সমূহ তথা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করা হজের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তাদের উপর হজ্জ ফরয করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মক্কায় জমায়েত হয়। নশ্বর পৃথিবীর অবিনশ্বর মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এরশাদ করেন -“নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি নির্মিত হয়, সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছে এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর হেদায়েতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ।
অপরদিকে হজ্জকে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের মহাসম্মেলনও বলা যায়। পবিত্র হজ্জ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক মহামিলন অনুষ্ঠান।
প্রায় প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম (আ:) সর্বপ্রথম হজ্জের প্রবর্তন করেন। এর পর থেকে নবী-রাসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ্জ পালনের বিধান। হজরত মুহাম্মদ ( সা:) সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ্জ অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সে থেকে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব মুসলিমের এই মহাসম্মিলন। উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য লাভ। পাশাপাশি বিশ্ব মুসলিমদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির নবজাগরণ ঘটে হজ্জে।
হজের এ বিধানটি বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। হজ্জের রয়েছে একটি ইতিহাস, আছে তাৎপর্য ও শিক্ষা।
হাজীদের পদতলে নরম মৃত্তিকা, মাথার ওপর উন্মুক্ত নীলাকাশ, পরনে ধবধবে সাদা কাপড়। পোশাকে নেই কোন বাহুল্য বা আভিজাত্য। নেই নিজের শক্তি-সামর্থ্য, বংশ গৌরব ও জ্ঞানের উম্মত্ত অহংকার। বুদ্ধি-বিবেচনা ও কুটকৌশল প্রয়োগের নেই কোন সুযোগ। আছে কেবল নিজের পাপ মোচনে আল্লাহর ওপর ভরসা। এটিই হজ্জের আসল উদ্দেশ্য ও শিক্ষা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা এসে ঐতিহাসিক আরাফার প্রান্তরে একত্রে মিলিত হয়ে তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে এবং পবিত্র গৃহ বায়তুল্লাহ তাওয়াফসহ হজ্জের আহকাম ও আরকানগুলো আদায় করেন। সুনির্দিষ্ট এ আহকাম - আরকানগুলো আদায় করা মানেই হজ্জ আদায় করা।
হজ্জের উদ্দেশ্যে সফরকারী প্রত্যেক হাজীর অন্তর খুব আবেগ আপ্লুত হয় কখন তাঁর দৃষ্টি সীমানায় খানায়ে কাবা দেখা যাবে। কখন প্রিয় রাসুলের রওজায় সালাতু সালাম পেশ করবে এবং রাসুলের স্মৃতিময় ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহ সচক্ষে দেখবে। এহরামের কাপড় পরিধান করার সাথে সাথে এই অনুভূতি প্রবলভাবে নাড়া দেয় বায়তুল্লাহর মেহমানদের অন্তরে। তাছাড়া
এহরামের কাপড় গায়ে জড়ানোর সাথে সাথে একজন হাজীর অন্তরে এদৃশ্যও ভেসে উঠে যেন সে কাফন পরে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে যাত্রা করছে। তখন হজ্জটা হয়ে উঠে শুধু মাত্র রবের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার মোক্ষম মাধ্যম। গুনাহের মাপ নিয়ে বাকিটা সময় পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের চুক্তিবদ্ধ অঙ্গিকার।
ইবাদত হিসেবে হজ্জের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে যত নেক আমল রয়েছে তার মধ্যে হজ্জ অন্যতম। রাসূল (সাঃ) অন্য সকল আমলের উপর হজ্জের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে হজ্জের গুরুত্ব পাঠকের সামনে তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।
কুরআনের আলোকে হজ্জের গুরুত্বঃ
পবিত্র কুরআনে অসংখ্য জায়গায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজ্জের গুরুত্ব যেমন বুঝিয়েছেন তেমনি কাবায় আগমনের গুরুত্বও বর্ণনা করেছেন বিশদভাবে।
আল্লাহ কা‘বাকে সম্মানিত ঘর করেছেন, মানুষের স্থীতিশীলতার কারণ করেছেন’’(সূরা মায়েদা -৯৭)
অন্যত্র বলা হয়েছে- আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম , যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্য , ইতিকাফকারীদের জন্য এবং রুকু ও সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’। সুরা বাকারা- ১২৫।
হজ্জের গুরুত্ব বুঝাতে আল্লাহ তায়াল পবিত্র কুরআনের সুরা আল ইমরানের ৯৭নং আয়াতে এরশাদ করেন- এতে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে, (যেমন) মাক্বামে ইব্রাহীম (পাথরের উপর ইব্রাহীমের পদচিহ্ন)। যে সেখানে প্রবেশ করে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ্জ্ব করা তার জন্য অবশ্যই কর্তব্য। আর যে অস্বীকার করবে সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ জগতের প্রতি অমুখাপেক্ষী। এই আয়াতটি হজ্জ ফরয হওয়ার মূল দলিল।
মহান আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আর তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সব ধরনের (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের ওপর সওয়ার হয়ে, দূরদূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখিরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে এবং রিজিক হিসাবে তাদেরকে দেয়া গবাদিপশু গুলো জবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে’। (সূরা হজ্জ,২৭-২৮) এসব আয়াত দ্বারা হজ্জের গুরুত্ব স্পষ্ট বুঝা যায়।
হাদিসের আলোকে হজ্জের গুরুত্বঃ
হযরত ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আকরা বিন হারেস নবী করীম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ্জ কি প্রতি বছর ফরজ না জীবনে একবারই ফরজ ? তিনি বললেন, না। বরং হজ্জ জীবনে একবার ফরজ। যে অধিক করবে তা তার জন্য নফল হবে।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ইয়াজূজ ও মাজূজ বের হওয়ার পরও হজ্জ ও ওমরাহ পালিত হবে’। হজ্জ এমন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও তা সম্পাদন করতে হবে। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন ‘বায়তুল্লাহ জিয়ারত ( হজ্জ) বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামত হবে না’।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্জ করার নিয়ত করে সে যেন অবিলম্বে তা আদায় করে। কারণ মানুষ কখন অসুস্থ হয়ে যায়, কখনো প্রয়োজনীয় জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং কখনো অপরিহার্য প্রয়োজন সামনে এসে হজ্জ পালন বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,তোমরা দ্রুত ফরজ হজ্জ সম্পাদন কর। কারণ তোমাদের কেউ জানে না কখন অপরিহার্য প্রয়োজন সামনে এসে যায়’। ইবাদত হিসাবে হজ্জ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় রাসূল (সাঃ) দ্রুত হজ্জ সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সাইয়্যেদেনা হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করবে না তারা ইহূদি ও নাসারা অবস্থায় মারা যাবে’। এর দ্বারা হজ্জের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে এবং ফরজ ত্যাগ করার পরিণতি কি তা উল্লেখ করা হয়েছে।
হজ্জের ফজিলতঃ
মিল্লাতে ইবরাহিম তথা মুসলিম মিল্লাতের উপর হজ্জ ফরয করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। উদ্দেশ্য প্রিয় বান্দাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতের অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দেয়া। হজ্জের প্রতিটি কাজ সম্পাদনের জন্য আলাদা আলাদা ফজিলতের ঘোষণাও দিয়েছেন মহান রব। রাসুল (সাঃ) হজ্জের যে ফজিলত ও মর্যাদা উল্লেখ করেছেন তা হলো-
১. সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর মতোই নিষ্পাপ হবে হজ্জ পালনকারীঃ
বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করছে, এবং সকল অশ্লীল কথা ও কাজ পরিহার করেছে, সে ব্যাক্তি হজ্জ হতে ফিরবে সদ্য জন্ম নেয়া মাসুম বাচ্চার মতো নিষ্পাপ হয়ে। অর্থাৎ ঐ ব্যাক্তির বড়- ছোট, প্রকাশ্য-গোপন সকল গুনাহ থেকে এমনভাবে মুক্ত হয়ে ফিরে আসে ; যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
২. কবুল হজ্জের প্রতিদান হলো জান্নাত ঃ
হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত ছগিরা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আর জান্নাতই হলো কবুল হজ্জের একমাত্র প্রতিদান। হজ্জে মাবরূর বা কবুল হজ্জ বলতে ঐ হজ্জকে বুঝায়, যে হজ্জে কোন গুনাহ করা হয়নি এবং যে হজ্জের আরকান-আহকাম সবকিছু কুরআন ও সুন্নাহ'র আলোকে পরিপূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন ‘হে উপস্থিত মানবসকল তোমরা অতি শীঘ্রই তোমাদের রবের সামনে একত্রিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। অতএব সাবধান! তোমরা আজকের পর যেন আবার পথভ্রষ্ট হয়ে না যাও।
৩. হজ্জ পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ ধ্বংস করে দেয়ঃ
ইবনু শামাসা আল-মাহরী (রঃ) বলেন, আমরা আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে গেলাম। তখন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কান্না করলেন এবং দেয়ালের দিকে মুখ লুকিয়ে রাখলেন। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহর ইচ্ছায় আমি যখন আমার অন্তরে ইসলামের শ্বাশত সৌন্দর্য অনুভব করি তখন আমি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট অনুরোধ করলাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, যাতে আমি বায়াত করতে পারি। রাসূল (সাঃ) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। তখন নবী কারীম (সাঃ) বললেন, কি ব্যাপার আমর ? আমি বললাম, আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন, কি শর্ত করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন। রাসুল (সাঃ )বললেন, হে আমর! তুমি কি জানো না, ঈমান আনার সাথে সাথে আল্লাহ তোমার অতীতের সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন এবং ‘হিজরত’ তার পূর্বেকার সকল কিছুকে বিনাশ করে দেয়। একইভাবে ‘হজ্জ’ তার পূর্বের সবকিছুকে বিনষ্ট করে দেয়'।
৪. পাথর, বৃক্ষরাজি, মাটি অন্য সবকিছুই হাজীদের সম্মানে তালবিয়া পাঠ করেঃ
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যখন কোন মুসলিম তালবিয়া পাঠ করে তখন তার ডানে ও বামে পাথর, বৃক্ষরাজি, মাটি সবকিছুই তার সাথে তালবিয়া পাঠ করে। এমনকি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত (তালবিয়া পাঠকারীদের দ্বারা) পূর্ণ হয়ে যায়’
৫. হজ্জ অভাব ও গুনাহ সমূহ দূর করে-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা হজ্জ ও ওমরাহর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখো (অর্থাৎ সাথে সাথে কর)। কেননা এ দু’টি মুমিনের দারিদ্রতা ও গুনাহ সমূহ দূর করে দেয়। যেমন- (কামারের আগুনের) হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে দেয়। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়’।
৬. হজ্জ হলো শ্রেষ্ঠ জিহাদঃ
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনাদের সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণ করব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য উত্তম ও উৎকৃষ্ট জিহাদ হল হজ্জ, কবুল হজ্জ। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর নিকট থেকে এ কথা শোনার পর আমি আর কখনো হজ্জ ছাড়ব না’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আয়েশা (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাদের উপর ‘জিহাদ’ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে সেখানে যুদ্ধ নেই। সেটি হল হজ্জ ও ওমরাহ’।
৭. অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল হজ্জঃ
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনা। বলা হলো, তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কি? তিনি বললেন, কবুল হজ্জ’।
৮.বায়তুল্লাহর মালিকের মেহমান হাজীগণঃ
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর মেহমান হলো তিনটি দল- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী, হজ্জকারী ও ওমরাহ্কারী’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীগণ আল্লাহর মেহমান। তারা দোয়া করলে আল্লাহ সে দোয়া কবুল হয়। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন’। অপর বর্ণনায় রয়েছে, ‘তারা কোন কিছু চাইলে আল্লাহ তা দিয়ে দেন’।
৯. ফেরেশতাদের সামনে হাজীদের প্রশংসাঃ
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘আরাফার দিন ব্যতীত অন্য কোন দিন আল্লাহ এত অধিক পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন না। ঐদিন আল্লাহ নিকটবর্তী হন। অতঃপর আরাফার ময়দানে উপস্থিত হাজীদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন এবং বলেন, দেখ ঐ লোকেরা কি চায়’? অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ ওদের ডেকেছেন তাই ওরা এসেছে। এখন ওরা যা চাইবে আর আল্লাহ তা দিয়ে দিবেন’।রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ দু'আ হলো আরাফার দিবসের দু‘আ’।
১০. হজ্জের নিয়ত করেও সওয়াব পাবেঃ
বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্জ, ওমরাহ কিংবা জিহাদের উদ্দেশ্যে ঘর হতে বের হলো এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকী লিখে দিবেন’।
১১/ হজ্জে মৃত্যুবরণকারীগণ হাশরের মাঠে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠবেঃ
ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে অবস্থান কালে হঠাৎ সে তার সাওয়ারী হতে পড়ে যান। এতে তাঁর ঘাড় মটকে গেলো (এবং তিনি মারা গেলেন)। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, তাঁকে বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও এবং দু’কাপড়ে তাঁকে কাফন দাও। তাঁকে সুগন্ধি লাগাবে না এবং তার মস্তক আবৃত করবে না, কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তাঁকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উত্থিত করবেন’।
১২. হাজীদের প্রতিটি পদে নেকী অর্জিত হয়ঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লায় সাতটি ত্বাওয়াফ করবে, এ সময় প্রতি পদক্ষেপে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকী লিখেন এবং একটি গুনাহ মাফ করে দেন।
হজ্জের শিক্ষাঃ
পবিত্র হজ্জ কেবল আর্থিক ও আত্মিক ইবাদত নয়। এ যেন সুখ -শান্তি, সৌহার্দ্য্- সম্প্রীতি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের বার্ষিক মহা সম্মিলন। পবিত্র হজ্জ পালন আমাদেরকে ধর্মীয়, আধ্যত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বুদ্ধি বিচক্ষণতা অর্জনের সে শিক্ষাই দিয়ে থাকে।
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবও আন্তর্জাতিক সম্মিলন। এ সম্মিলনে মুসলমানদের ঐক্যের ধারা ও ভ্রাতৃত্ববোধ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
হজ্জ থেকে লাভ করা যায় সাম্যের শিক্ষা। কালো- সাদা,রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নানান দেশের নানান ভাষার মানুষ ইহরাম অবস্থায় সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হজ্জ পালন করে মহামহিম রবের সান্নিধ্যে লাভের আশায়। এ দৃশ্য যেন পৃথিবীবাসীকে সাম্য ও ঐক্যের শিক্ষা প্রদান করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
ইহরাম অবস্থায় একজন হাজী যে সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলেন তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে- মুমিনের জীবন উদ্দেশ্যহীন নয় বরং শৃঙ্খলিত এবং আল্লাহর রশিতে বাঁধা। ইহরাম অবস্থায় সকল অন্যায় জুলুম ও ঝগড়া করা নিষেধ। এর অর্থ মুমিন কখনো ঝগড়াটে হয় না, পাপাচারী হয় না এবং কারো প্রতি জুলুম করে না। ঝগড়া-বিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে একজন মুমিন সহজ সরল সুন্দর ও সহনশীল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। মুমিন ক্ষমা, ধৈর্য্য ও উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
হজ্জের সময় বিভিন্ন দেশের, বর্ণের, পেশার, ভিন্ন মতের নানান মানুষ যখন এক ইমামের নেতৃত্বে নামাজ আদায় করেন তখন ইসলামের শ্বাশত সৌন্দর্য নিঃসন্দেহে বিকশিত হয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ একসাথে অবস্থান করে বলে ভাষার দূরত্ব যেমন দূর হয়ে তোমনি পরস্পরের মাঝে আত্মিক সম্পর্কও তৈরি হয়। প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। মনের সংকীর্ণতা দূর হয় এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়ে চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। একদেশদর্শী মনোভাব দূর হয়ে বহুদর্শিতা ও দূরদর্শিতা অর্জিত হয় হজ্জের মাধ্যমে। প্রকৃত হাজী তাদেরকেই বলা যায় , যাঁরা হজের প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে ধন্য হন। হজ্জকে জীবন পরিবর্তনের অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ্জ পরবর্তী জীবনে হজ্জের শিক্ষা বাস্তবায়ন করেন। এখানে সংক্ষেপে হজ্জের আরো কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
তাওহীদ তথা একত্ববাদের অঙ্গিকারঃ
তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের পূর্ণতা ও ঈমানের দৃঢ়তা হজ্জের প্রথম ও চূড়ান্ত শিক্ষা।
আল্লাহ যে এক ও একক একথার ঘোষণা দিয়েই হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করতে হয়। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক- থেকে শুরু করে বিদায় তাওয়াফ পর্যন্ত হজ্জের প্রতিটি আমল আমাদের এ শিক্ষাই দিয়ে থাকে। তাওহীদ শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আকিদা ও বিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে তা আমাদের কর্ম ও আচরণে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, চালচলনে দৃশ্যমান থাকতে হয়।
হজ্জের সময় সমস্বরে তালবিয়াহ পাঠের মাধ্যমে যে ঘোষণা দিয়ে থাকে তা যেন আমৃত্যু টিকে থাকে। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা, ওয়ান নেয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক। অর্থ- হে আল্লাহ, আমি হাজির, আমি হাজির আপনার দরবারে আছি। আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির । নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই জন্য এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই। সারাজীবন এ ঘোষণায় দৃঢ় থাকা মুমিন জীবনের প্রথম লক্ষ্য।
আনুগত্য ও আত্মসমর্পণঃ
হজ্জের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো একজন মুমিন তার জীবনকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তাঁর নিজের বলে কিছু থাকবে না। আল্লাহর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে জাগতিক কাজকর্ম বাস্তবায়ন করবে কেবল চিরস্থায়ী জান্নাত লাভের আশায়।
হজ্জের যাবতীয় বিধি-বিধানে সে আনুগত্যের অনুশীলন করা হয়। তাছাড়া একজন হাজী যখন কাবাগৃহের নির্মাতা হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর অবস্থা স্মরণ রাখেন তাখন তিনি অবশ্যই হজ্জ থেকে আনুগত্যের শিক্ষা গ্রহণ করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, আনুগত্যে নতশির হও, তখন সে (সাথে সাথে) বলল, আমি রাব্বুল আলামিনের প্রতিটি হুকুমের সামনে আমার মস্তক নত করে দিলাম। (সুরা বাকারা -১৩১)
হজ্জ ঐক্য ও অধিকারের স্মারকঃ
হজ্জের নানাবিধ অনুষ্ঠানিকতা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও অধিকারের অবিচ্ছেদ্য সংহতির এক অনন্য নিদর্শন। প্রিয়নবী (সাঃ) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘"আরবের ওপর আযমের এবং আযমের ওপর আরবের কোন প্রাধান্য নেই"। সব মানুষই আদি পিতা আদমের সন্তান। রাসূলের বাণীকে কবি অত্যন্ত সুন্দর করে পেশ করেছেন :
চরণে দলিনু অন্ধ যুগের বংশ অহংকার,
ভাই ভাই মিলি মুসলিম যত এক মহাপরিবার।
নাহি ভেদাভেদ আযমী আরবী,
একই আদমের সন্তান সবই।
ধূলায় রচিত আদম তনয়, গৌরব কিসের তার? হাবশীও যদি সত্যের পথে বরণীয় হয়,
এ জগতে তারি নির্দেশ নত মস্তকে মানিবে সুনির্দিষ্ট সুনিশ্চিত।
ধৈর্য্য ও ত্যাগঃ
ধৈর্য্য ও ত্যাগের মূর্ত প্রতিক সাইয়্যেদেনা হযরত ইবরাহিম (আঃ)। কঠিন বিপদ মুসিবতে কি করে পাহাড়ের মতো অবিচল থাকা যায় বা থাকতে হয় তা আমাদেরকে দেখিয়েছেন হযরত ইবরাহিম ( আঃ)। কলিজার টুকরো স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) এর কুরবানি সম্পর্কিত ঘটনা থেকেই ধৈর্য্য, অবিচলতা এবং ত্যাগের শিক্ষা লাভ করা সম্ভব। কেমন ধৈর্য্য ও অবিচলতা সুরা সাফফাতের ১০২ নং আয়াতে তা স্পষ্ট।
ইসমাঈল (আঃ) বললেন,হে আমার পিতা! আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে সবরকারীদের সাথেই পাবেন।
আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকাঃ
মুমিনের জীবনে হতাশা বলতে কিছুই নেই।
জীবনের যেকোন সময় যেকোন পরিস্থিতিতে
আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট থাকা তাওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তির প্রথম কাজ।
আল্লাহ তাঁর বান্দাকে অধিক পরিমাণ ভালোবাসেন বলেই কাউকে ধন সম্পদ, সন্তানাদি দিয়ে পরীক্ষা করেন। আবার কাউকে চরম অর্থ কষ্টে নিপতিত করেন। কাউকে নিঃসন্তান করেও পরীক্ষা করেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ আমার একমাত্র ও শুধুমাত্র সাহায্যকারী মনে করে রবের সিদ্ধান্ত সন্তুষ্ট থাকা মুমিন জীবনের অন্যতম লক্ষ্য।
বায়তুল্লাহর হিদায়াত ও বরকতসমূহঃ
ইসলামের মূল ভিত্তিই হলো তাওহীদ। আর
বায়তুল্লাহর প্রধান হিদায়াত হলো তাওহীদ ও একতা। ঈমানের মৌলিক শিক্ষা বা দাবিই হলো বিশ্ব শান্তি বজায় রাখা ও আমানতদারিতা রক্ষা করা। যে বায়তুল্লাহ হজ করল অথচ বায়তুল্লাহর হিদায়াত ও বরকত সাথে নিয়ে আসতে পারল না, তাহলে তার এ হজ্জে কি লাভ হলো?
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘বাস্তবতা এই যে মানুষের ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই সেটি মক্কায় অবস্থিত, এবং তৈরির সময় থেকেই এ ঘরকে বরকতময় ও সমগ্র মানুষের জন্য হিদায়াতের উপায় হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন।
বিশ্বজনীন জাতীয়তাবোধের শিক্ষাঃ
হজ্জ মুসলিম উম্মাকে বিশ্বজনীন জাতীয়তা শিক্ষা দেয়। পবিত্র গৃহ কা'বাকে কেন্দ্র করে যে সভ্যতা ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক সার্বজনীন সমাজ ও বিশ্বরাষ্ট্র গঠে উঠেছে তা বিশ্ববাসীর জন্য ঐতিহাসিক শিক্ষা।
পিতা-মাতার প্রতি আনুগত্যঃ
পবিত্র হজ্জব্রত পালন করার সৌভাগ্য যাদের
হয়েছে, তাদেরকে হজরত ইসমাঈল (আঃ) এর দৃষ্টান্ত থেকে পিতা-মাতার প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক। যতক্ষণ পিতা-মাতা জীবিত আছে ততক্ষণ নিজের চাওয়া পাওয়াকে মা বাবার সন্তুষ্টির জন্য যথাসম্ভব কুরবানী দেয়া হজ্জের অন্যতম শিক্ষা ।
আল্লাহর নির্দেশ পালনে স্বামীর অনুসরণঃ
হজরত ইবরাহিম (আঃ) ও বিবি হাজেরা (রাঃ)-এর ঘটনা মুসলিম দম্পতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তা হলো, স্বামী যদি স্ত্রীকে আল্লাহর কোনো নির্দেশ ও নির্দেশনা মান্য করতে আহ্বান জানায়, তবে স্ত্রী তার আনুগত্য করবে। রাসুল (সাঃ) খোদাভীরু ও সৎ স্বামীর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তুমি ভেবে দেখো, তার কাছে তোমার স্থান কোথায়? কারণ সে-ই তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম।’ একইভাবে স্বামী, স্ত্রীর সৎ পরামর্শ মেনে নেবে এবং তার ত্যাগ ও কুরবানিকে মূল্যায়ন করবে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি, যে নিজের স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। আমি তোমাদের সবার চেয়ে আমার স্ত্রীদের জন্য সর্বোত্তম ।
সন্তানদের সৎ চরিত্রবান ও ঈমান মজবুত করণের শিক্ষাঃ
হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও বিবি হাজেরা (রাঃ)-এর জীবন থেকে সব পিতা-মাতার এই শিক্ষা নেয়া উচিত যে কি করে সন্তানকে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। একজন সন্তানও কি করে মা বাবার সিদ্ধান্তকে কোন প্রশ্ন ছাড়া হাসিমুখে মেনে নেয়। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকতে হয়। যেসব পিতা-মাতা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত তাদের জানা দরকার যে, আমাদের আসল ভবিষ্যৎ হলো আখিরাত। যে ব্যক্তি তার সন্তানের আখিরাত ধ্বংস করলো কিংবা তাদের আখিরাতকে সাজানোর বিষয়ে কোনো চিন্তাই করল না, প্রকৃতপক্ষে সে সন্তানের কোনো অধিকার ও দায়িত্বই পালন করলো না। তাই সন্তানকে ঈমান আমল ও পরকালীন মুক্তি শিক্ষা দিতে হজ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহারঃ
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে হজ্জের গুরত্ব, মর্যাদা ও তাৎপর্য অপরিসীম। সাম্য, ঐক্য ও বিশ্ব ভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজ্জের রয়েছে সীমাহীন গুরুত্ব। ভাষাগত পার্থক্য, বর্ণ বৈষম্য, গোত্রতো অহমিকা এবং সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও নানান দেশের লাখো মুসলিম প্রতি বছর কাবা অঙ্গনে হাজির হয়। যেখানে নেই কোন লোভ- লালসা, অহংকার, দুনিয়ার মোহ আর অর্থের গৌরব। আছে কেবল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্বরে বিশ্ব জাহানের একচ্ছত্র মালিক মহান প্রভুর দরবারে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার ব্যাকুলতা। ডুবে থাকা পাপ সমুদ্র থেকে বাঁচার অযুত কণ্ঠের আকুতি। পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ জীবনের কামনা অহর্নিশ। সত্যি সে এক অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় মন জুড়ানো দৃশ্যপট।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, পবিত্র হজ্জ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে চূড়ান্ত সফলতা এনে দেয় এবং বিশ্ব মুসলিম সমাজের ঐক্যকে আরো গতিশীল ও মজবুত করে। শুধুমাত্র হাজী বা আলহাজ্ব উপাধি পাওয়ার আশায় নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন ও সকল প্রকার পাপাচার থেকে বিরত থেকে উন্নত জীবন গঠনে হজ্জের ভূমিকা অপরিসীম।
প্রেরকঃ
মোজাম্মেল হোসেন
সহকারি অধ্যাপক (বাংলা)
কবি ও প্রাবন্ধিক, ফেনী।
( তথ্য সূত্র, পবিত্র কুরআন ও হাদিস এবং উইকিপিডিয়া )
ReplyForward |