শরতের আম গৌরমতি
গাড়ি থেকে নামতেই ভাদ্রের উত্তাপটা বেশ টের পাওয়া গেল। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর গ্রামে এসেছি সম্ভাবনাময় নতুন আম ‘গৌরমতি’ সম্পর্কে জানতে। সেপ্টেম্বরের প্রথম ভাগ বা ভাদ্র মাসের শুরুতেই দেশে যখন সব অভিজাত আমের মৌসুম শেষ, তখন এই আম পাকতে শুরু করে; থাকে সারা মাস। বেশ চাহিদা থাকায় পাইকারি বাজারেই এ আম প্রতি মণ এখন ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১২ সালে প্রথম এই আম সম্পর্কে জানতে পারে। একেবারেই নতুন জাতের এই আমের একটি মাতৃগাছ পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শিয়ালমারী গ্রামের স্কুলশিক্ষক মো. এরফান আলীর আমবাগানে। আমটির স্বাদ, গড়ন ও পরিপক্বতার মৌসুম হিসাব করে তারা গাছটির কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করে। পরের বছরই চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টার ‘মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প’–এর মাধ্যমে এ মাতৃগাছ থেকে বেশ কিছু কলম তৈরি করে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালের মধ্যে কৃষি বিভাগ সারা দেশে ব্যাপকভাবে গৌরমতির চারা-কলম ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে দুই শতাধিক মাতৃগাছ থেকে তৈরি কলমগুলো দেশের ৭০টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশে পাওয়া যাচ্ছে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞের গোড়ার দিকে গাছটি শনাক্তকরণ, নামকরণ, গবেষণা ও বংশবৃদ্ধির কাজে যাঁরা গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অন্যতম তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ এস এম কামরুজ্জামানসহ মো. আবু হানিফ মিয়া, মো. সাইফুর রহমান ও আবদুল আউয়াল।
গবেষকেরা মনে করছেন, গৌরমতি মূলত আশ্বিনা ও ল্যাংড়া—এই দুই জাতের আমের মুকুলে প্রাকৃতিক পরাগায়নের ফলে সৃষ্ট একটি নতুন জাত।
কৃষি বিভাগ দেশে আমের মৌসুম দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ থেকে ২০১৬ সালে জামনগর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষিবিদ মো. গোলাম মাওলাকে প্রাথমিকভাবে ১৫০টি গৌরমতি আমের একটি প্রদর্শনী বাগান তৈরি করে দেওয়া হয়। লাভজনক হওয়ায় পরবর্তী সময়ে তিনি আরও ৬০ বিঘা জমিতে গৌরমতির বাগান সম্প্রসারণ করেন। এ বছর কোভিডের বৈরী পরিস্থিতিতেও তিনি এ বাগান থেকে প্রায় আট লাখ টাকার গৌরমতি আম বিক্রি করেছেন। শুধু গৌরমতি আমই নয়, ৫ একর মিশ্র ফলের বাগানে ৬০ প্রজাতির বিচিত্র ফলের এক বিপুল সমারোহ গড়ে তুলেছেন তিনি। প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মেহেদি মাসুদ জানিয়েছেন, ‘একইভাবে দেশের অন্যান্য প্রদর্শনী বাগানেও এ বছর গৌরমতির ভালো ফলন হয়েছে। আমের বিলম্বিত এই নতুন জাত নিয়ে আমরা বেশ আশাবাদী।’
গৌরমতি বড় আকারের গাছ। অন্যান্য জাতের সঙ্গে একই সময়ে মুকুল এলেও আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। এই আম ডিম্বাকৃতির, প্রতিটি ২৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হতে পারে। পরিপক্ব ফলের রং হালকা হলুদ। শাঁস রসাল, হলদেটে ও আঁশহীন। মিষ্টতা সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৭৫ ভাগ। সূত্র: প্রথম আলো