যে সাত কারণে বাংলাদেশে ই-কমার্স সহজ নয়

যে সাত কারণে বাংলাদেশে ই-কমার্স সহজ নয়

আপাতত বাংলাদেশে ই-কমার্স সহজ নয়; অন্তত আগামী ১০ বছরে তো অবশ্যই নয়। কথাগুলো শুনে অনেকেই হতাশ হবেন, জানি। তবে মাঝেমধ্যে কিছু চরম সত্যি কথা কোথাও লিখে রাখা ভালো। কিছু মানুষের নজরে এলে তারা হয়তো বেঁচেও যেতে পারেন। এই চরম সত্যি কথাগুলো হয়তো অনেকের স্বার্থের বাইরে যাবে। তাতে তারা ক্ষিপ্ত হবেন বৈকি! তবে কিছু সাধারণ মানুষ হয়তো এ লেখা পড়ে বেঁচে যাবেন। সে জন্যই লিখতে বসা। এবার চলুন কারণগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক।

১. এটি লম্বা দমের ব্যবসা!
ই-কমার্সএকটি লম্বা দমের ব্যবসা। এই ব্যবসায় মোটামুটি লাভের মুখ দেখতে সময় লাগবে অন্তত ১২ বছর। যে উদ্যোক্তা ৪০ বছর বয়সে এটা শুরু করবেন, তিনি ৫২ বছর বয়সে গিয়ে লাভের মুখ দেখলেও দেখতে পারেন; কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে এ সময়ের আগে যে লাভ দেখা যাবে না– সেটা নিশ্চিত।

বিশ্বের যেসব দেশে ই-কমার্স সফল হয়েছে, তাদের এমনই সময় লেগেছে। অসংখ্য দেশে এখনও ই-কমার্সে বিনিয়োগ চলছে এই আশায়, একদিন লাভের মুখ দেখা যাবে। তবে বিফলে যাওয়ার আশঙ্কাও কম নয়। 
এত লম্বা ‘দম’ বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ীর নেই। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দু-তিন বছরের মধ্যেই বিনিয়োগের অর্থ ঘরে তুলতে চান। এত লম্বা সময় ধরে বিনিয়োগ আটকে রাখতে চান না এবং সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এত লম্বা সময়ে নীতিগত পর্যায়ে অনেক পরিবর্তন হতে পারে। তখন পুরোই হাতে হারিকেন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হতে পারে। ফলে ১২ বছরের একটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় কেউ বিনিয়োগ করবেন না। অথবা কেউ কেউ এই ব্যবসায় নামেন মানুষ ঠকানোর আরেকটা ‘ভ্যালি’ তৈরি করার জন্য।

২. ছোট বাজার!
বাংলাদেশে ই-কমার্স মার্কেট খুবই ছোট! একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বলুন তো, কারা ই-কমার্স ব্যবহার করে কেনাকাটা করে? বাংলাদেশের মতো একটি উঠতি অর্থনীতির দেশে এখন পর্যন্ত মেয়েরা ঘরে বসে পাকিস্তানি বা ভারতীয় কাপড় ফেসবুকে বিক্রি করে; অন্য মেয়েরা সেই শাড়ি-কাপড়, গহনা কেনে। এটাকে বলে এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক কমার্স)। প্রকৃত ই-কমার্স বলতে আমরা যা বুঝি, তার গ্রাহক খুবই কম!
ই-কমার্সের প্রকৃত গ্রাহক নতুন প্রজন্মের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, যাদের সময়ের খুব মূল্য কিংবা অলস প্রকৃতির। তারা এতই ব্যস্ত, ঘরে বসে একটু বেশি টাকা ব্যয়ে আয়েশ করে জিনিসটা পেতে চায়; নয়তো এতই অলস, বাজারে যেতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশে সেই লোকের সংখ্যা কত? এখানে মানুষের হাতে অনেক সময়। তারা ইউরোপ-আমেরিকার মতো ব্যস্ত নয়। আমরা এখনও এমন ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হইনি যে, ঘরে বসে অসংখ্য মানুষের পণ্যের অর্ডারে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চলতে পারে। ঢাকা শহরে কয়েক লাখ মানুষও হবে না, যারা প্রকৃতপক্ষে ই-কমার্সের গ্রাহক। তবে হ্যাঁ, কম দামে পণ্য দিলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে বৈকি! সেটা যে প্রতারণার ফাঁদ– তা তো আমরা এতদিনে বুঝেই গেছি। সেই আলোচনায় আসছি!


৩. বাংলাদেশে ই-কমার্স লাগবে কেন?
বিশ্বে অনেক কিছুই ঘটে এবং ঘটছে; তার সবকিছুই বাংলাদেশে হতে হবে কেন? বাংলাদেশে ই-কমার্স লাগবে কেন? বাংলাদেশ কি আমেরিকার মতো বিশাল মহাদেশ যে হাতের কাছে সবকিছু পাওয়া যায় না? কিংবা গাড়ি চালিয়ে তারপর বাজার করে নিয়ে আসতে হয়? 

মানুষ মূলত তিনটি কারণে ই-কমার্স ব্যবহার করে– ক. যা হাতের কাছে পাওয়া যায় না। দূরে কোথাও অন্য কারও কাছে আছে। নিজের সময় বাঁচানোর জন্য মানুষ ই-কমার্স ব্যবহার করে। খ. দুষ্প্রাপ্য পণ্য– এমন কোনো পণ্য, যা সাধারণ দোকানগুলো রাখে না কিংবা খুবই স্পেশাল দোকানে পাওয়া যায়। গ. মূল্য কম! 
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনটি প্রযোজ্য? 

বাংলাদেশকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো ঢাকা, আরেকটি হলো অ-ঢাকা (ঢাকার বাইরে)। এই তো বাংলাদেশ! ঢাকা শহরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। তাই তারা স্বাচ্ছন্দ্য চাইতে পারে। তারা ই-কমার্সে যেতে পারে। কিন্তু বলুন তো, ঢাকায় কোন এলাকায় কোন জিনিসটা পাওয়া যায় না? তাকে কোন পণ্যটির জন্য ই-কমার্সে যেতে হবে? যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, তাদের তিন-চারজন সাহায্যকারী নয়তো ড্রাইভার থাকে। চাহিবা মাত্র তারা আশপাশের দোকান থেকে সেগুলো নিয়ে আসতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কিছুর জন্যই তাদের ই-কমার্স ব্যবহার করতে হয় না। শুধু দুষ্প্রাপ্য কিছু পণ্যের জন্য ঢাকার মানুষকে ই-কমার্স ব্যবহার করতে হয়। এর বাইরেও যে গোষ্ঠী ই-কমার্সে কেনাকাটা করে, তাদের সংখ্যা খুবই ছোট। তাদের ওপর ভরসা করে কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না।

এবার আসা যাক ঢাকার বাইরের মানুষের কথায়। বাংলাদেশে সরবরাহ ব্যবস্থা এত ভালো যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। ছোট একটি দেশ। পাওয়া না-যাওয়ার কোনো কারণই নেই। তবে ঢাকায় এমন কিছু বিলাসী পণ্য পাওয়া যায়, যেগুলো ঢাকার বাইরে পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই বিলাসী পণ্যগুলো ঢাকার বাইরের মানুষের ক্রয়সীমার ভেতরে নয়। ফলে ঢাকার বাইরের মানুষ ফেসবুকে ভারতীয় বা পাকিস্তানি পোশাক কেনে। ওটাই অনলাইনে কেনাকাটা।
বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে ই-কমার্সের প্রয়োজন নেই। সাধারণ কমার্সই যথেষ্ট। এর বাইরে ছোট যে মার্কেট আছে, সেটা ঘরে বসেই মেয়েরা পুষিয়ে নিয়েছে।

৪. ট্যাক্স-ভ্যাট
বাংলাদেশের মেয়েরা যে ঘরে বসে ভারতীয় বা পাকিস্তানি পোশাক বিক্রি করে, তার একটি বড় কারণ এখানে কোনো ভ্যাট-ট্যাক্সের বালাই নেই। বেশির ভাগই হলো ক্যাশ অন ডেলিভারি এবং এ পদ্ধতিতে কখনও কেউ ভ্যাট চার্জ করেছে বলে শুনিনি। এ পদ্ধতিতে ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার নিয়ম থাকলেও, সেটা প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যেদিন থেকে এগুলো প্রয়োগ করা হবে তখন দেখবেন এখানেও কেনাবেচা কমে যাবে।
যখনই একটি প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সে আসবে তখন তাকে ট্যাক্স ও ভ্যাট দিয়েই ব্যবসা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তার দাম বেশি হবে। সেটা দিতে বাংলাদেশের গ্রাহকরা এখনও প্রস্তুত নয় এবং সে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের গ্রাহকরা আমেরিকার মতো সেবা চাইবে, তবে তার জন্য টাকা দিতে চাইবে না। ফ্রি হলে আরও ভালো!

৫. অসততা!
শুনতে খারাপ লাগলেও এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া ভালো, বাংলাদেশে অসৎ মানুষের হার নেহাত কম নয়। সেটা ব্যক্তিজীবন কিংবা ব্যবসায়িক জীবনে। আপাতদৃষ্টিতে অনেক সৎ মানুষও আবার সুযোগ পেয়ে অসততা করে। এমন উদাহরণ দৈনন্দিন জীবনেই দেখা যাবে। 
স্বল্পসংখ্যক সৎ মানুষ দিয়ে তো আর কোনো সিস্টেম পরিচালিত হতে পারে না। যে কোনো সিস্টেমকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হলে বেশির ভাগ মানুষকেই সৎ হতে হবে। তাহলে সিস্টেমটি চলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যেমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা চর্চার সুযোগ কম; তেমনি বেশির ভাগ ক্রেতাও সৎ থাকতে পারেন না। যে কারণে নিজে গিয়ে কিছু একটা কিনে দোকান থেকে বের হওয়া মাত্রই তা আর ফেরত দেওয়া যায় না। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাসের কারণেই পুরো অনলাইন কেনাকাটা হয় ক্যাশ অন ডেলিভারিতে। এখানে বিক্রেতাকে কেউ বিশ্বাস করে না। এক জিনিসের ছবি দেখিয়ে অন্য জিনিস গছিয়ে দেওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। আবার উল্টোটাও সত্যি। যদি মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুই টাকা কম পাওয়া যায়, তাহলে আমরা মিথ্যা তথ্যই দেব। 

এটিই বাংলাদেশ! 
অসততা দিয়ে ই-কমার্স হয় না। পৃথিবীতে কোথাও হয়নি। ই-কমার্সের প্রাথমিক ধারণাই হলো বিশ্বাস এবং সততা! আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ বেশির ভাগ মানুষকে বিশ্বাস করতে চায় না বা পারে না। 

৬. প্রতারণা
বাংলাদেশে কেউ ই-কমার্স শুরু করে কম দামে পণ্য বিক্রি শুরু করলেই বুঝবেন, গ্রাহক ঠকানোর ফাঁদ পাতা হয়েছে। বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে জনস্বার্থে ব্যবসা চালাবে– এমন ব্যক্তি এ দেশে কবে জন্ম নিল গো!
যে কোনো ডিজিটাল সেবা সেই দেশের মানুষের একটা জেনারেশনকে পাল্টে দেয়। তাদের জীবনযাত্রা পাল্টে দেয়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজের টাকা খরচ করে কেন সেটা করতে যাবে? তার এত টাকা আসবেই বা কোথা থেকে! কে দেবে? নিজের পরিবার? ব্যাংক? নাকি গৌরী সেন? এটা কোনো ধরনের ব্যবসায়িক ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই পড়বে না। ফলে তাকে একটা প্রতারণার ফাঁদ পাততেই হবে। বাংলাদেশে বিগত দিনে তা-ই হয়েছে। আগামী অনেক দিনেও এর ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ কম। 
হুট করেই একটি খাত সৎ হয়ে যাবে আর বাকি সব চলবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে– সেটা হতে পারে? টাকা সব সময় মুনাফার পেছনেই ছুটবে। যেহেতু বাংলাদেশের বেশির ভাগই সঠিক নিয়মে চলে না, তাই এখানে ই-কমার্স হওয়ার সুযোগও কম। ই-কমার্সের সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা! বাংলাদেশে ট্রান্সপারেন্সির যে পরিস্থিতি, তাতে ই-কমার্স বিকশিত হবে কীভাবে?

৭. ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডিং
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা বা বিনিয়োগ পাবে কোথা থেকে– এই প্রশ্ন করা মাত্রই সবাই আঙুল দেখাবে– কেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) আছে না? ভিসিরা টাকা দেবে! একটিবারের জন্যও কেউ জানতে চায় না, ভিসিরা কেন টাকা দেবে? তাদের টাকা কি গাছে ধরে?


ভিসিরা টাকা পায় কোথা থেকে? তারা টাকা নিয়ে আসে ধনী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। তারা বাজারে একটা হাইপ তোলে– এই কোম্পানিটি বিলিয়ন ডলারের হয়ে যাবে। এটা বলে তারা ধনীদের কাছ থেকে টাকা তোলে। তারপর তারা সেই টাকা বিনিয়োগ করে স্টার্টআপগুলোতে। তারপর সেটাকে কোরবানির গরুর মতো মোটাতাজা করে; চেষ্টা করে শেয়ারবাজারে এসে সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে। দিন শেষে বেচারা সাধারণ মানুষ বোকার মতো স্টক কেনে। মূল হোতারা মার্কেট থেকে বের হয়ে যায়। ততদিনে স্টকের দাম পানির দামের চেয়েও কমে যায়! কারণ ওটাকে ভ্যালুয়েশন করা হয়েছিল আপনাকে ঠকানোর জন্যই (সম্প্রতি ভারতের বাইজু ও পেটিএমের গল্প একটু পড়ে নেবেন দয়া করে!)

এটি একটি বিশাল চক্রের জুয়া খেলা। সেটা নিয়ে আদ্যোপান্ত লেখা যাবে আরেক দিন। আপাতত শুধু বলে রাখি, বাংলাদেশে যেহেতু স্টক মার্কেটে এই খেলাটা এখনও খেলা যাচ্ছে না, তাই ভিসিরা এখানে আসছে না। স্থানীয় ভিসি যেমন নেই, বিদেশিরা এখানে এখনও মধু দেখতে পাচ্ছে না। মানুষকে ঠকিয়ে মধুপানের সুযোগ দেখলেই সেই সব ভোমরা এসে হাজির হবে। আমাদের কয়েক কোটি মানুষকে ঠকতে হবে!

বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ ছেলেমেয়ে বর্তমানে স্টার্টআপের স্বপ্ন দেখছে বা দেখানো হচ্ছে। যদি দেশের মানুষের উপকারের চিন্তা থেকে স্টার্টআপের স্বপ্ন দেখানো হতো, তাহলে ভালো ভালো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খুঁজে বের করে তাদের বড় করার জন্য বিনিয়োগ করা হতো। 
ছোট ভাইবোনেরা, স্টার্টআপ করার আগে একবার হলেও তোমাদের বিজনেস কেসটা আমাকে দেখিয়ে নিও। আমি যতটা এই পথে হেঁটেছি, তার থেকে সামান্য নিলেও তোমাদের জীবনটা বেঁচে যাবে। 
এগুলো কঠিন সত্য কথা! নিজের জীবন দিয়ে দেখা! ওপরের এই সাতটি বিষয় মাথায় থাকার পরও যদি দেখেন কেউ ই-কমার্স নিয়ে উদ্যোগী হচ্ছে, তাহলে হয়তো না বুঝেই কাজটা করছে। আর কেউ কেউ, আগেই বলেছি, গ্রাহক ঠকানোর জন্যই নতুন নতুন ফন্দি তৈরি করছে; যে ফাঁদে ধরা পড়তে পারে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ, অসহায় মানুষ!

জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক. Source: Samakal