বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের অর্ধেক আইসিইউ নষ্ট
মোট আইসিইউ শয্যা ১০১টি। এর মধ্যে নবজাতকের আইসিইউ ২০টি ও শিশুদের আইসিইউ ২০টি।
আইসিইউর মধ্যে ৪২টিই নষ্ট। ২০টি আইসিইউ কোনো দিন চালু করা হয়নি। মোট ৬২টি আইসিইউ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
বিএসএমএমইউতে এইচডিইউ শয্যা আছে ১৪টি। এর মধ্যে ৪টি শয্যা নষ্ট।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্ধেকের বেশি আইসিইউ নষ্ট। আইসিইউ চালাতে জনবলেরও সংকট রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি মুহূর্তের এই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু ও বয়স্ক রোগীরা।
জটিল, সংকটাপন্ন ও মুমূর্ষু রোগীদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসা দরকার হয়। দেশে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর সংকট আছে। আইসিইউর জন্য রোগীর স্বজনদের দৌড়াদৌড়ির বিষয়টি অনেকটা নিয়মিত হয়ে পড়েছে।
বিএসএমএমইউর আইসিইউতে খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এখানে সাধারণ আইসিইউর দৈনিক ভাড়া ২ হাজার ১০০ টাকা। লাইফ সাপোর্ট যন্ত্র ও মনিটরের ব্যবহার হলে আরও ৯৬০ টাকা দরকার হয়। অর্থাৎ দৈনিক খরচ ৩ হাজার ১০ টাকার বেশি নয়। আর নবজাতকের জন্য দৈনিক খরচ দেড় হাজার টাকা। অন্যদিকে ঢাকার যেকোনো মাঝারি মানের বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে খরচ দৈনিক ১৫ হাজার টাকা।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন গাড়িচালক পবিত্র ঈদুল আজহার দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাঁকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়।
পরে ওই গাড়ির চালককে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা একপর্যায়ে তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করানোর কথা বলেন। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। এরপর ঢাকার প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার খোঁজ করা হয়। কিন্তু কোথাও তা পাওয়া যায়নি। এরপর ওই গাড়িচালককে মহাখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ওই রোগীর প্রতিদিন ২০ হাজার টাকার বেশি বিল হচ্ছে।
মাসের পর মাস আইসিইউ নষ্ট
গত বুধবার বিএসএমএমইউর উপাচার্যের কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে আইসিইউ শয্যা আছে ১০১টি। এর মধ্যে নবজাতকের আইসিইউ ২০টি ও শিশুদের আইসিইউ ২০টি। মোট আইসিইউর মধ্যে ৪২টিই নষ্ট। আর ২০টি আইসিইউ কোনো দিন চালু করা হয়নি। এ নিয়ে ৬২টি আইসিইউ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। মাসের পর মাস ধরে এসব আইসিইউ কাজে আসছে না।
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগী সুস্থ হওয়ার পর প্রথমে তাঁকে এইচডিইউতে (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) রাখা হয়। এইচডিইউ থেকে রোগী আরও সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে সাধারণ ওয়ার্ড বা কেবিনে নেওয়া হয়। বিএসএমএমইউতে এইচডিইউ শয্যা আছে ১৪টি। এর মধ্যে ৪টি শয্যা নষ্ট।
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর সহ–উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন নিয়োগ হয়েছে। নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর নষ্ট বা অকার্যকর আইসিইউর তালিকা তৈরি করার পাশাপাশি সেগুলো চালু করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জনবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ ছাড়েরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শিশুরা সেবা পাচ্ছে না
বিএসএমএমইউর সি ব্লকের দ্বিতীয় তলায় নবজাতক বিভাগ। এই বিভাগে শূন্য থেকে ২৮ দিন বয়সী শিশুদের জন্য বিশেষ আইসিইউ রয়েছে। একে বলে নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (এনআইসিইউ)। এখানে শয্যাসংখ্যা ২০।
গত বুধবার নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার দের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, গতকাল সাতটি নবজাতক ভর্তি ছিল। ১৩টি এনআইসিইউ শয্যা খালি ছিল। যন্ত্রপাতির ঘাটতির কারণে এগুলো চালু করা যাচ্ছে না।
সঞ্জয় কুমার দে জানান, সব কটি শয্যা চালু রাখতে হলে ভেন্টিলেটর দরকার ২০টি, আছে মাত্র ২টি। এনআইসিইউতে নবজাতকের শরীর গরম রাখার জন্য ‘রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার’ নামের বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্র দরকার ২০টি, সক্রিয় আছে ৮টি। নানা ধরনের যন্ত্রপাতির কমতির কারণে সব কটি শয্যায় রোগী ভর্তি করা হয় না।
সব কটি শয্যা চালু করতে হলে যন্ত্রপাতি বাবদ তিন কোটি টাকার মতো খরচ করতে হবে বলে জানান সঞ্জয় কুমার দে। সমস্যার কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সমস্যা চলছে বেশ আগে থেকে। এক বছর আগেই উপাচার্যকে লিখিতভাবে সব সমস্যার কথা জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে শিশুদের (২৮ দিন থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত) আইসিইউ সেবা নেই। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০ শয্যার শিশুদের আইসিইউ চালু করার যাবতীয় যন্ত্রপাতি কেনা আছে। জায়গারও সংকট নেই। কিন্তু শিশুদের আইসিইউ চালু হচ্ছে না।
বিভিন্ন বিভাগে আইসিইউ নষ্ট
জটিল রোগীর চিকিৎসায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন নামের একটি বিভাগ রয়েছে। এখানে আইসিইউ শয্যা ৩২টি। বিভাগে গত বুধবার ৩১ জন রোগী ভর্তি ছিল। এই বিভাগে সব আইসিইউ চালু আছে। কিন্তু এখানে সমস্যা অন্য রকম।
আইসিইউর দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মন্তোষ কুমার মন্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ ঘণ্টা আইসিইউ রোগীর প্রতি নজর রাখতে হয়। প্রত্যেক আইসিইউ রোগীর জন্য একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণ পাওয়া নার্স থাকা দরকার। নার্স আছে কম। সকালের পালায় দুজন রোগীর জন্য একজন নার্স দেওয়া হয়, সন্ধ্যার পালায় নার্সের সংখ্যা আরও কমে যায়। প্রতি পালায় ছয়-সাতজন করে আয়া ও ওয়ার্ড বয় দরকার। কিন্তু কাজ করেন দু-তিনজন।
এই বিভাগের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বিভাগের আইসিইউতে বছরের ১২ মাসই রোগীর চাপ বেশি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ থেকেও এখানে রোগী পাঠানো হয়।
বিএসএমএমইউর দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকে পাঁচটি তলায় প্রতিটিতে দুটি করে মোট ১০টি আইসিইউ শয্যা আছে। এর একটিও চালু নেই। এ ছাড়া শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগ রেসপিরেটরি জরুরি বিভাগ, হৃদ্রোগজনিত কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ ও কার্ডিওলজি বিভাগ এবং শিশু নেফ্রোলজি বিভাগে আরও ১৯টি আইসিইউ শয্যা আছে। এগুলো কাজ করে না।
বিএসএমএমইউ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। নিজেদের আয় ও সরকারের অনুদানে চলে। এখানকার চিকিৎসকদের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের বদলির কোনো ঝুঁকি নেই বলে কাজের ক্ষেত্রে তারা অনেকটাই স্বাধীন। বেশি পরিমাণে সেবা, মানসিক সেবা, মানসম্পন্ন সেবা যেন দিতে পারে, সে জন্য সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়। বিএসএমএমইউর কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না।
রোগীদের অপেক্ষা
কোনো কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎই রোগীর আত্মীয়কে বলে, রোগীকে আইসিইউতে নিতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে ভাড়া বেশি হওয়ায় অনেকে সরকারি হাসপাতাল বা বিএসএমএমইউতে ভর্তি করাতে চান। এই জরুরি অবস্থায় আইসিইউ পাওয়া যায় না। বিএসএমএমইউর নবজাতক বিভাগে আইসিইউ পেতে সব সময় অপেক্ষমাণের তালিকায় চার-পাঁচজন রোগী থাকে।
অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগেও অপেক্ষমাণ রোগীদের তালিকা দীর্ঘ। বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অপেক্ষমাণের তালিকায় ৪০-৫০ জন থাকে। অনেকের পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে অন্য হাসপাতালে বেশি অর্থ ব্যয়ে এই সেবা নিতে হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, উদ্যোগ ও সমন্বয়হীনতার কারণে দেশের অন্যতম সেরা এই চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের আইসিইউ নষ্ট পড়ে আছে। মানবিক ও উন্নত সেবার সংস্কৃতি এখানে গড়ে ওঠেনি।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নত ও মানবিক সেবার সংস্কৃতি এখনো এখানে গড়ে ওঠেনি। ১০১টি আইসিইউ সচল, সক্রিয় থাকলে এই প্রতিষ্ঠান বহু মানুষের জীবন রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারত। এর প্রভাব পড়ত অন্যান্য সেবায়। এখান থেকে যাঁরা ডিগ্রি নেন, তাঁদের অনেক সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল। দুঃখের বিষয়, এর কিছুই হচ্ছে না।’ সুত্রঃ প্রথম আলো