পানির তীব্র সংকটে বিপর্যস্ত বান্দরবানবাসী

পানির তীব্র সংকটে বিপর্যস্ত বান্দরবানবাসী

আমিনুল ইসলাম খন্দকার, বান্দরবান: পরিবেশগত কারণে বছরের প্রায় ছয় মাসই পানি সংকট থাকে পাহাড়ি কন্যা হিসেবে পরিচিত বান্দরবানে। পাহাড়ে প্রায় সবকয়টি পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে গেছে। এতে তীব্র ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয় মানুষ।


স্থানীয়রা জানান, জেলার দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত সবাই ঝিরির  পানি ও ঝরনার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে অধিকাংশ ঝিরি শুকিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। পানি সংকটে কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের জীবন। দিন দিন বেড়েই চলেছে এই সংকট।

এর ফলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধরা। এসব রোগে মৃত্যুর খবরও আসে প্রায় প্রতিবছর। পানি সংকটের কারণে পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেকেই।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন মাইলের পর মাইল খাবার পানির জন্য পাড়ি দিচ্ছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। গ্রীষ্মে পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না তারা। সদর উপজেলার চিম্বুক এলাকায় শতাধিক পাহাড়ি পল্লীতে পানির জন্য হাহাকার বিরাজ করছে। সদরসহ অন্য ছয় উপজেলা রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি এলাকাগুলোতে খাবার ও ব্যবহারের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গরম ও পানির সংকটে দিশেহারা পাহাড়ের জনজীবন । 


জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ম্রোলং পাড়া, সেই পাড়ার বাসিন্দা রেংপং ম্রো বলেন,আমাদের পাড়ায় প্রচুর পানির কষ্ট। পানির কোনো ভালো উৎস নেই, প্রাকৃতিকভাবে ঝিরিতে কিছুটা পানি পেতাম তবে গরমের কারণে ঝিরিও শুকিয়ে গেছে।


বান্দরবানে চিম্বুক এলাকার প্রায় ৯০টি ম্রো পাড়ায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বহুদিন ধরে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট হওয়ায় বাধ্য হয়েই ঝিরির নোংরা পানি পান করে জীবনধারণ করছেন তারা।


সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উপরে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের বিভিন্ন পাড়াতে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট লেগেইে থাকে। আর মার্চ থেকে মে এই তিন মাস যেন পানির কষ্ট আরও বেড়ে যায় ম্রো পাড়াগুলোতে।

বিশুদ্ধ পানির কষ্টে এখন দিনযাপন করছে চিম্বুক পাহাড় এলাকার রামড়ী পাড়া, ম্রলং পাড়া, বাগান পাড়া, বাইটা পাড়া, হেডম্যান পাড়া, যামিনী পাড়াসহ ৯০টি পাড়ার বাসিন্দারা।


রামড়ী পাড়ার কারবারী (পাড়া প্রধান) মেনরুম ম্রো বলেন, চিম্বুক এলাকার মানুষের এখন সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো পানি। নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার ও খাবার জন্য কোথাও পানি নেই। ফল বাগানে দেওয়ার মত পানিও নেই।


বিশেষ করে সদর উপজেলার সুয়ালয়ক ইউনিয়নের ১৫টি ম্রো পাড়ার পাঁচ হাজার মানুষ ও টংকাবতী ইউনিয়নের ৭৫টি ম্রো পাড়ায় ১৫ হাজার  মানুষ তীব্র পানির সংকটে ভুগছেন।


আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছরে বান্দরবান জেলার ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ মিটার উচ্চতায় বায়ুর গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে গত সাত বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। বায়ুর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মাটির তাপমাত্রাও বেড়েছে। ফলে মাটির উপরিভাগের পানি বাষ্প হয়ে যাচ্ছে শুকিয়ে। শুষ্ক মৌসুমে নদী ও ছড়াগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে।


বান্দরবানে বিশুদ্ধ পানির সংকট নিয়ে  সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন এলাকা ও পাড়া ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ের প্রায় সব কয়টি ঝিরি ও ঝরনা শুকিয়ে গেছে।


গত বছর চিম্বুক পাহাড়ে পানির সংকটের কথা শুনে তৎকালীন  জেলা প্রশাসক ইয়াসিন পারভীন তীবরীজী সেখানে গিয়ে বাঁধ দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা বাঁধ নির্মাণের জন্য জায়গা পর্যন্ত মেপে যান। কিন্তু বছর পার হয়ে গেলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই বলে অভিযোগ করেন পাড়াবাসীরা।


এ বিষয়ে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপ কুমার বলেন, পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে ঝিরির পাশের তথা পানির উৎসের পাশের গাছ কেটে ফেলার কারণে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, পানির লেয়ার মাটির অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় পাহাড়ে তাড়াতাড়ি পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে মাটির গর্ভে পাথর থাকায় গভীর নলকূপ বসানোর মত সুযোগ নেই। তবে পাহাড়ের ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি।