নোয়া: গর্বের সাথে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে বুকে ধারণ করে যারা
১৯৬৮ সালে বগুড়ায় পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠান নোয়া, ২০০০ সালের গোড়ার দিকে প্রেসার কুকার উৎপাদন শুরু করে। এখন শুধু প্রেশার কুকারই নয়, অন্যান্য রান্নার সরঞ্জামও ভারত, ভুটান, মায়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে রপ্তানি করছে তারা।
২০০৩ সালে প্রেশার কুকার যখন ভারতজুড়ে রান্নাঘরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন নোয়া'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজু পোদ্দার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের রান্নাঘরেও এই পণ্যের প্রবেশ ঘটাবেন।
যেই চিন্তা সেই কাজ। নিজের কোম্পানির ব্যানারে ভারত থেকে দক্ষ কারিগরদের দিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রেসার কুকার তৈরি এবং তাদের দিয়ে দেশের কারিগরদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই নোয়া বাংলাদেশে উন্নতমানের প্রেসার কুকার উৎপাদন করতে শুরু করে।
কিন্তু ইতোমধ্যে প্রেস্টিজ এবং হোকিংসের মতো বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন রান্নার সরঞ্জাম দিয়ে বাজার দখল করে রেখেছিল। দেশীয় থেকে আমদানি করা বিদেশি পণ্য মানে ও গুণে ভালো এমন ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল মানুষের মনে।
রাজু পোদ্দার বলেন, 'আমাদের প্রেসার কুকারগুলো বিদেশি ব্র্যান্ডেড পণ্য়ের চেয়ে বেশি ভালো না হলেও তাদের সমতুল্য ছিল। আমরা যখন নিউমার্কেটের বিভিন্ন দোকানে প্রেসার কুকার সৌজন্য উপহার দিই, তখন প্রত্যেক বিক্রেতারা প্রথমে তা পছন্দ করেন। কিন্তু যখনই তারা 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সিলমোহরটি দেখে, তখন তারা দ্বিধায় পড়ে যায় এবং এটি বিক্রি করতে অপারগতা জানায়।'
রাজু জানান, তাদের প্রেসার কুকার বাজার ধরতে পারছিল না যতক্ষণ না পর্যন্ত মেইড ইন বাংলাদেশ লেখাটি সরানো হয়েছিল। অবাক করার বিষয় হলো 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সিল সরানোর পর থেকেই তাদের প্রেসায় কুকারের বিক্রি বাড়তে থাকে।
তবে সিল ছাড়াই বিক্রির কয়েক বছর পর রাজু 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সিল পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।
এখন শুধু প্রেশার কুকারই নয়, অন্যান্য রান্নার সরঞ্জামও ভারত, ভুটান, মায়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও রপ্তানি করছে নোয়া।
রাজু বলেন, 'কলকাতায় নোয়া গর্বের সঙ্গে অন্য ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। অন্যান্য ব্র্যান্ড থেকে আমাদের পণ্য বেশি মূল্য সাশ্রয়ী এবং আমরা ওইখানে ভালো ব্যবসা করছি, আয়ের পরিমাণও ভালো।'
শুরুটা কীভাবে?
নোয়া কিচেনওয়্যার পোড্ডা পরিবারের পারিবারিক ব্যবসা। রাজু পোদ্দারের পিতা নন্দলাল পোদ্দার ভারতের রাজস্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং দেশভাগের আগে ১৯২০ সালে বগুড়া জেলায় চলে আসেন।
নন্দলাল পোদ্দার শিক্ষিত না হলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরদর্শী। শুরু করেছিলেন বগুড়ায় একটি চাল ও তেলের মিল দিয়ে।
মাটির বাসনপত্রের পরিবর্তে মানুষ যখন আস্তে আস্তে অ্যালুমিনিয়ামের পণ্য ব্যবহার করতে শুরু করে, নন্দলাল তখন অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে একটি লাভজনক সম্ভাবনা দেখতে পান।
তিনি ১৯৬৮ সালে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে আত্মপ্রকাশ করেন। 'সূর্য মার্কা'র ব্যানারে তিনি কানাডা থেকে আমদানি করা অ্যালুমিনিয়ামের কয়েল থেকে বগুড়া জেলার তালোরায় অ্যালুমিনিয়ামের কিচেনওয়্যার, প্যানসহ থালা-বাসন তৈরি করতেন। নন্দলালের সব সন্তানেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা বগুড়ায়।
তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে আমি বগুড়ায় বসবাস করছি। আমিও বগুড়ার শেরপুর থেকে বিএ পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ করতে ভর্তি হই। কিন্তু পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে হওয়ায় মাস্টার্স চালিয়ে যেতে পারিনি।
রাজুর নির্দেশনায় ১৯৭৮ সালে ব্যবসায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে বিভিন্ন অ্যালুমিনিয়াম পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় নোয়া গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রয়েল রিলাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ। সময়ের সাথে সাথে, প্রায় ১৫ টি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে রাজু পোদ্দারের মালিকানাধীন একটি ছিল। বর্তমানে তিনি রয়েল রিল্যাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
যাইহোক, কোম্পানির প্রকৃত রূপান্তর ২০০৪ সালে শুরু হয় যখন এটি স্টিলের তৈরি প্রেসার কুকার উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তীকালে রাইস কুকার, গ্যাস স্টোভ, কেটলি, ব্লেন্ডার, ইন্ডাকশন স্টোভ এবং নন-স্টিক পণ্য উৎপাদন করাও শুরু করে তারা। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি শুরু করে নোয়া।
বর্তমানে পোদ্দার পরিবারের সবাই মিলে প্রতিষ্ঠানটির দেখভাল করছেন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে আছেন রাজু পোদ্দার, তার ভাই গোকুল কুমার পোদ্দার এবং মালিকানায় আছেন গোকুল কুমারের স্ত্রী পূজা দেবী পোদ্দার। শুরুতে বিদেশি কারিগর দিয়ে কারখানা পরিচালনা করা হলেও, প্রশিক্ষণের পর এখন দেশীয় কারিগররাই দক্ষতার সাথে কারখানায় কাজ করছেন।
শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে অ্যালুমিনিয়াম ইনগট আমদানি করে আসছে। রাজু জানান, তাদের উৎপাদন ব্যয়ের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়।
স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি নোয়া বাইরের দেশগুলোতেও তাদের পণ্য রপ্তানি করছে। রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র শোরুম রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের জমজমাট বাজার
বাংলাদেশে প্রেসার কুকার, ইলেক্ট্রিক কেটলি বা রাইস কুকারের মতো রান্নার সরঞ্জামসমূহকে শহুরে মানুষদের জন্য অপরিহার্য মনে না হলেও, রাজু পোদ্দার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন।
তিনি বলেন, 'ঢাকার মানুষ সৌভাগ্যবান যে, আবাসিক রান্নার জন্য এখানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গে, যেখানে সেই বিলাসিতা নেই, সেখানে মানুষ পোর্টেবল সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। খরচ বাঁচাতে প্রেসার কুকার ও বৈদ্যুতিক কেটলির মতো বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী পণ্য সেখানে অপরিহার্য। এই পণ্যগুলো সেখানে অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় এবং ফলস্বরূপ সেখানে আমাদের একটি সমৃদ্ধ ব্যবসা রয়েছে।'
রাজু আরও জানান, শীতকালে উত্তরবঙ্গে শীতের তীব্রতা বেশি থাকে। সেখানে সবার গিজার ব্যবহার করে পানি গরম করার সুযোগ থাকে না। তখন বৈদ্যুতিক কেটলিগুলো বিভিন্ন প্রয়োজনের জন্য দ্রুত পানি গরম করার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
বিশ্বজুড়ে বাজার
রাজু পোদ্দার কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স শিল্প এবং তার সহযোগী ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। বাজারকে নতুন রূপ দেওয়ার জন্য কিয়াম, মিয়াকো, আরএফএল, শরীফ মেলামাইন এবং ওয়ালটনের মতো ব্র্যান্ডের প্রশংসা করেন তিনি।
রাজুর মতে, আগে বাংলাদেশ রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, ব্লেন্ডারের মতো রান্নাঘরের জিনিসের জন্য আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। তবে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতার একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এসব পণ্যের মাত্র ১ শতাংশ এখন আমদানি করা হয়, স্থানীয় উৎপাদন এখন বাজারের ৯৯% নিয়ন্ত্রণ করছে।
তিনি বাংলাদেশের বাইরেও নোয়ার বাজার সম্প্রসারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথাও জানান। তারা ইউরোপীয় অঞ্চলে তাদের পণ্য রফতানির সুযোগ অন্বেষণ করছে, যেখানে ক্রমবর্ধমান চাহিদা রয়েছে।
রাজু ব্যাখ্যা করে বলেন, 'পশ্চিমা অঞ্চলে চীনবিরোধী আন্দোলন চলছে এবং তারা কিছুটা বেশি খরচেও এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে ইচ্ছুক।'
তবে পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখনও ইউরোপের বাজারে তার সম্প্রসারণ ঘটাতে পারছে না।
তিনি বলেন, 'ভ্যাট ও ডিউটি ফি কমানোর জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এই শিল্পের সম্ভাবনা তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে তুলনীয় এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের অবশ্যই এটিকে কাজে লাগাতে হবে।'