কাতারের আমিরের সফরে কতটা লাভবান হলো বাংলাদেশ

কাতারের আমিরের সফরে কতটা লাভবান হলো বাংলাদেশ

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির ঢাকা সফর ছিল ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের। কিন্তু সংক্ষিপ্ত হলেও সফরটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুই দফায় ৭০ মিনিটের বেশি সময় আলোচনায় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলেছেন শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি।

বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানির সফরের ১৯ বছর পর ঢাকায় এসে তিনি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। ঢাকা আর কক্সবাজারে বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ, মেট্রোরেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মাণ দেখে গেছেন নিজের চোখে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে উচ্ছ্বসিত কাতারের আমির বলেছেন, ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং।’

বাংলাদেশ ও কাতারের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সংযুক্তি, পর্যটনসহ নানা খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজতে কাতারের আমির আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তিনি দেশে ফিরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে।

কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা এলেই জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসার বিষয় আলোচনায় আসে। তবে এবার কাতারের আমিরের ঢাকা সফরে ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বার্তাও পাওয়া গেছে।

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা সফর করেন। তবে এই সফরে তাঁর আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ছিল মঙ্গলবার। এদিন সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে শুরুতে একান্তে আলোচনা করেন ২৫ মিনিটের মতো। পরে তাঁরা দুজন ৪৫ মিনিটের বেশি সময় আলোচনা করেন। দুই শীর্ষ নেতার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এরপর কাতারের আমির বঙ্গভবনে তাঁর সম্মানে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বঙ্গভবন থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেস দিয়ে তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। বাংলাদেশ ও কাতার—দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রের সঙ্গে মঙ্গলবার এই প্রতিবেদকের কথা হয় প্রধানমন্ত্রী ও আমিরের মধ্যে বৈঠকের বিষয়ে। দুই সূত্রই অনেকটা একই সুরে বলেছেন, একান্ত আলোচনা শেষে দুই শীর্ষ নেতা বেশ খোশমেজাজে বেরিয়ে আসেন। দুজনই একে অন্যের ইস্যু নিয়ে জবাব দিয়েছেন, মত দিয়েছেন। ফলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আলোচনার পথ ধরে এগিয়ে যাবে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, কাতারের আমির নিজের চোখে বাংলাদেশ দেখে যে অভিভূত, সেটা তিনি নিজেই বলে গেছেন। বৈঠকের এক পর্যায়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন, সিয়িং ইজ বিলিভিং। ফলে এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কাতারের দৃষ্টিভঙ্গির যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি আরও বলেন, ‘এই সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক বহুমাত্রিক হবে এবং সম্পর্ক রাজনৈতিক পর্যায়েও একটা উত্তরণ ঘটেছে। সামগ্রিকভাবে সম্পর্ক কয়েক ধাপে এগিয়েছে বলেই আমরা আশা করি।’

সম্পর্কের চালিকা শক্তি যখন ব্যবসা

বাংলাদেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের অন্যতম উৎস কাতার। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যে সম্প্রতি আড়াই শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, তাতে প্রাধান্য এলএনজির। বাংলাদেশে জ্বালানিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার কাতার মনে করছে, এ দেশে যে ধারায় উন্নয়ন এগিয়ে চলছে, এলএনজির চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে জ্বালানির পাশাপাশি অন্য কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুযোগ আছে, সেটা যাচাই করা জরুরি।

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, কাতার এখন যে এলএনজি বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করে, সেগুলো জাহাজে করে বন্দরে বহির্নোঙরে এনে সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এলএনজি সরবরাহের জন্য তাদের টার্মিনাল তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সমুদ্রবন্দর অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে কাতার এলএনজি সরবরাহব্যবস্থায় যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে।

প্রসঙ্গত, কাতার থেকে প্রতিবছর ১৫ লাখ মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির জন্য গত জানুয়ারিতে পেট্রোবাংলা ও কাতার গ্যাসের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে নতুন এ চুক্তি কার্যকর হবে।

পর্যটন ও কক্সবাজারে বিনিয়োগের প্রস্তাব

কাতারের আমির বাংলাদেশের সঙ্গে পর্যটন খাতে সহযোগিতার আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিশেষ করে দুই দেশ একে অন্যকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে বিনিয়োগের জন্য কাতারের আমির শেখ তামিমকে অনুরোধ জানান। তিনি জানান, কক্সবাজারে বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন খাতের বিকাশে কক্সবাজারে বিনিয়োগ করার কথা ভাবতে পারে কাতার। এ ছাড়া কাতারের জন্য দেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সুযোগ তো থাকছেই। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন কাতারের আমির। তিনি দেশে ফিরে কাতারের বিনিয়োগ বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব সুযোগকে কাজে লাগানোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে গেছেন।

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়

বাংলাদেশে কাতারের আমিরের সফরটা এমন এক সময়ে হলো, যখন ইরান–ইসরায়েল সংঘাতসহ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরো বিশ্ব। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে গাজায় ইসরায়েলি হামলা ও সর্বশেষ ইরান-ইসরায়েল উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রসঙ্গটি এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তে থাকা অস্থিরতা ও সহিংসতা নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তাঁরা ফিলিস্তিন সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে বৈশ্বিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।

শীর্ষ বৈঠকের এক পর্যায়ে কাতারের আমির ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলাকে ‘পরিমিত পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, দুই পক্ষের কেউই পুরোদমে একে অন্যের ওপর হামলা চালিয়েছে, এমনটা নয়। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে দুই পক্ষের মধ্যে বড় আকারে কোনো সংঘাত ছড়াবে না বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশি জনশক্তিতে আগ্রহ থাকছে

বাংলাদেশ ও কাতারের সম্পর্কে বড় একটি ক্ষেত্র জনশক্তি রপ্তানি। বাংলাদেশের জনশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার কাতার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে এ মুহূর্তে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। কাতারে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সময় স্টেডিয়ামসহ অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক অবদান রেখেছেন। তবে অন্য অনেক দেশের মতো কাতারও এখন দক্ষ শ্রমিক চায় বাংলাদেশ থেকে। কাতার এখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, প্রকৌশলসহ নানা ক্ষেত্রের দক্ষ লোকজনকে কাজে নিতে চায়। তবে অল্প দক্ষ শ্রমিকদেরও যেন নেওয়া হয়, সেই অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। কাতার এতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।