ঈদুল ফিতরঃ সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন
মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন:
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম পালন শেষে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভাঁজে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ মিষ্টি হেসে জানান দেয় ঈদ এসেছে। আমাদের
জাতীয় জীবনে ঈদুল ফিতর খুবই তাৎপর্যূপূর্ণ । এটি মুসলিম মিল্লাতের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। একজন রোজাদার যে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ, উদারতা, মহানুভবতা ও মানবিক গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, তার প্রবাহমান গতি অক্ষুন্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন ঈদুল ফিতর। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সকলের হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। যে প্রভুর প্রেমে নিজের সকল ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে ত্রিশটি দিবস-রজনী সে অন্তর আজ প্রশান্তিতে ভরে উঠে ঈদের খুশিতে। চারদিকে শোনা যায় আমাদের জাতিস্বত্ত্বার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী বিখ্যাত সে গান-
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ...’
'ঈদ’ আরবি শব্দ। ‘আউদ’, শব্দ থেকে উৎপন্ন । এর অর্থ হলো এমন উৎসব, যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয় , রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভৃতি। এর আরেক অর্থ খুশি বা আনন্দ। সৌহার্দ্য- সম্প্রীতিতে পরস্পর হারিয়ে যাওয়ার অনাবিল মুহূর্ত। ঈদ প্রতিবছর আরবি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে।
‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। অন্য অর্থে বিজয় । দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব পালন করা হয় তাকেই ঈদুল ফিতরের উৎসব বলা হয় । বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। একমাস কঠোর সংযম পালন করে মানুষ তাঁর ভিতরকার সব রকমের খারাপ ইচ্ছা ও খেয়ালখুশিকে দমন করে মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের ব্রত গ্রহণ করে। এটি মুমিন বান্দার এক ধরনের বিজয় বা সফলতা। সেই অর্থে এটি বিজয় উৎসবও বটে।
সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্ববোধের অনন্য সম্মিলন ঈদ। ছোট-বড়,
ধনী-গরিব পরস্পর বুকে বুক মিলিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধের যে মেলবন্ধন তৈরি হয় তা মুসলমানদের হাজার বছরের সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। যে সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেয় উঁচু- নীচুর ভেদাভেদ । ভুলে যায় পুরনো বিষাদ,ক্রোধ ও ক্ষোভ। প্রেম-প্রীতির আহ্লাদে নেচে উঠে মন। পাড়া প্রতিবেশীর মাঝে, আমাদের সামাজিক জীবনে সৃজন হয় নতুন পারাবার। কেননা ঈদ নিছক কোন আনন্দ-বিনোদনের নাম নয়, এর মধ্যে নিহিত আছে সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন ও ধর্মীয় অনুশীলন চর্চার তাগিদ। ইসলাম যে শ্বাশত ও চিরন্তন ধর্ম, তাঁর মর্মবাণী হচ্ছে সামাজিক ঐক্য, সাম্য, মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা প্রকাশ ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন। বছর ঘুরে একমাস কঠিন কৃচ্ছ্বতা সাধন শেষে ঈদ আমাদেরকে সে আসমানী বার্তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিম্বব্যাপি মুসলিম দুয়ারে সমাগত পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ আমাদের ধর্মীয় উৎসব। ঈদ ধনী-গরিব সবার জন্যেই আসে। তবে ধনী-গরিবের আর্থিক বৈষম্যে ঈদ আনন্দ এখন এক প্রকার কঠিন হয়ে পড়েছে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। উঁচু-নিচুর পার্থক্য দূর করে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করবে এটাই ঈদের মৌলিক শিক্ষা।
ইসলামের শ্বাশত বাণী হলো ঈদের আনন্দ কেবল নিজে নয়; গরিবকেও সে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ করে দিতে হবে। নিজে যেমন ভালো পোশাক পরিধান করবে, তেমনি দরিদ্র, অসহায় মানুষকেও নতুন জামা ও ভালো খাবারের সুযোগ করে দিতে হবে ।
যদিও বর্তমানে আমাদের দেশ, সমাজের চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। ঈদ আসে কেবল ধনীদের জন্যই! ঈদের আগে-পরে ধনীদের যে আয়োজন এবং চোখেমুখে যে আনন্দের শিহরণ; গরিবের চেহারায় তার লেশমাত্রও দেখা যায় না। ধনিদের নতুন জামা,দামি দামি খাবার এবং ঘুরে বেড়ানোর উৎসব দেখে গরিবদের দীর্ঘশ্বাস কেবল বাড়তেই থাকে। পৃথিবীতে নিজেদের আগমনকে কেবল নিরর্থক মনে হয়।
ধনী-গরিবের এমন আকাশসম বৈষম্য কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে এমন বৈষম্য দূর করতে আল্রাহ তায়ালা যাকাতের বিধান দিয়েছেন।
ধনীদের সম্পদে গরিবের হক বা অধিকার নিশ্চিত করছেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা আল-জারিয়াত- ১৯)। পাশাপাশি সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন ধনীদের। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদাকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক কথা ও অশ্লীল ব্যবহার থেকে পবিত্র করার এবং গরিবদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য।’ (আবু দাউদ-১৬১১)। অর্থাৎ সাদাকাতুল ফিতর হলো গরিবের হক। গরিবও যেন ঈদে নতুন জামা কিনতে পারে। সেমাই, জর্দাসহ ভালো খাবার খেতে পারে। আনন্দের সঙ্গে অন্তত একটি দিন কাটাতে পারে।
অতএব, ঈদের আগেই সমাজের গরিব- অসহায়দের মাঝে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী জাকাত, ফেতরা সঠিকভাবে পৌঁছে দিয়ে তাদের ঈদকেও আনন্দময় করে তুলি। তাছাড়াও দান-সদাকার হাত প্রসারিত করে অন্তত একটি গরিব পরিবার বা একজন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিতে পারি আমরা। এভাবে দূর হোক ধনী-গরিবের বৈষম্য। ঈদ আসুক জনে জনে আনন্দের বার্তা নিয়ে। প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে। ঈদ হোক আমাদের সামাজিক জীবনে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক ঈদ-উল ফিতরের অপার্থিব আনন্দ।
লেখক:
সহকারী অধ্যাপক (বাংলা)
কবি ও প্রাবন্ধিক, ফেনী