ইয়াফেস ওসমানের বান্ধবি মালা খানের জালিয়াতির তেলেসমাতি

ইয়াফেস ওসমানের বান্ধবি মালা খানের জালিয়াতির তেলেসমাতি



ঢাকা মর্নিং ডেস্ক: কোন রকম যোগ্যতা ছাড়াই রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান গবেষনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস-বিআরআইসিএমের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেয়ে বছরের পর সব রকম সুযেোগ সুবিধা নিয়েছেন কম্পিউটার সায়েন্সের স্নাতক মালা খান। এই পদের জন্য আবশ্যকীয় পিএইচডি ডিগ্রি এবং বিজ্ঞান গবেষনা প্রতিষ্ঠানে ১৪ বছেরের কাজের অভিজ্ঞতা কোনটিই ছিল না মালা খানের। সকল তদন্তে ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে তার নামের পাশে ডক্টর লেখা রয়েছে এখনো। কোটি কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণও রয়েছে মালা খানের বিরুদ্ধে। এতসব অনিয়ম আর জালিয়াতির পেছনে বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেত্রী মালা খানকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।


বিআইসিএমের তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে, চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার ও বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি  মালা খান, তৎকালীন মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সাথে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ থাকার সুবাদে সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়েও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)-এর আওতাধীন ডেজিগনেটেড রেফারেন্স   ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (ডিআরআইসিএম) এর চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। 


২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাক ও ডেইলি স্টারে বিআরআইসিএম এর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শূন্য পদে  নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ৩৯.৩০৭.০১৪.০০.০২.৬৪৫.২০১৪/২৩৮ নং অফিস আদেশের মাধ্যমে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটি ডিআরআইসিএম এর প্রথম শ্রেণীর নিয়োগের জন্য জমা পড়া আবেদনসমূহ যাচাই বাছাই করে চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার পদে প্রাপ্ত ২টি আবেদনই বিজ্ঞপ্তির শর্ত ও তথ্যাদির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে বাতিলের জন্য সুপারিশ করে। 


উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞপ্তির চাহিদা ও শর্ত মোতাবেক প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞান গবেষণামূলক চাকরির ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকায় যাচাই বাছাই কমিটি কর্তৃক মালা খানের আবেদনের বাতিলের জন্য সুপারিশ করা হয়। তার প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞান গবেষণামূলক চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল ৮ বছর ৭ মাস (বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ৬ বছর ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ২ বছর ৭ মাস)। আবেদনপত্রে প্রদর্শিত প্লাজমা প্লাস, এপ্লিকেশন ও রিসার্চ ল্যাবরেটরীজ এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ল্যাবরেটরি ম্যানেজার পদের চাকরীর অভিজ্ঞতা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এটি সম্পূর্ণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং চাকরিতে যোগদানের সময় হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রার্থী কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত থাকায় শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সনদে প্রাপ্ত চাকরি এবং এর অভিজ্ঞতা চাকুরী সংক্রান্ত নিয়মাবলী অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া মালা খানের পিএইচডি সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন অনুমোদন করে না এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার পত্রে উল্লেখ করে যে  আমেরিকান ওয়ার্লড ইউনিভার্সিটি কর্তৃক মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রী প্রদান অনুমোদিত নয় এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের কোন এখতিয়ার নেই। 


যদিও তিন বছর পর মন্ত্রণালয় বিবৃতির মাধ্যমে কোন ধরনের কারণ ছাড়াই পত্রটি প্রত্যাহার করে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, উক্ত চিঠিটি তৎকালীন বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে চিঠিটি প্রত্যাহার করা হয়।   প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা দুই ক্ষেত্রেই বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না করেও পুনরায় ক্ষমতাসীন মহলের কারণে মালা খানের বাতিলকৃত আবেদনটি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ কর্তৃক হিসেবে গৃহীত হয় এবং চিফ সাইন্টিফিক অফিসার পদের পরীক্ষার্থী হিসেবে সুপারিশ  প্রাপ্ত হন যেখানে তিনিই ছিলেন উক্ত পদের একমাত্র পরীক্ষার্থী। 


মালা খানের চিফ সাইন্টিফিক  অফিসার পদে নিয়োগের সুপারিশটি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ২শ ৮৬ তম বোর্ড সভায় উত্থাপিত হয় এবং নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন করার সুযোগ নেই মর্মে জানানো হয়। পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের নির্দেশে  তিনি বিসিএসআইআর এর বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই নিয়ম বহির্ভূতভাবে চীফ সাইন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। এবং প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদও ভাগিয়ে নেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিসিএসআইআর বিজ্ঞানী সংঘ মালা খানের নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে, যেটি এখনো চলমান। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, তৎকালীন আওয়ামী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম কে ম্যানেজ করে মালা খান তার নিয়োগের বিরুদ্ধে চলামান মামলাটি স্থগিত করে রাখেন। 


উল্লেখ্য, আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে মালা খানের সিএসও পদে নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে তার পিএইচডি জালিয়াতি ও অবৈধ নিয়োগের সত্যতা প্রমাণিত হলে কমিটি তাকে চাকরি হতে বহিস্কারের সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশক্রমে মালা খানকে বহিস্কারের আদেশ জারি করা হলে, ধূর্ত মালা খান মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার বহিস্কার আদেশের ওপর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। চলতি মাসের শেষদিকে আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চে মামলাটি শুনানী হওয়ার কথা রয়েছে। 


মালা খান American World University, USA (affiliated Bangladesh Study Center, Center for Executive Development Studies (CEDS), 27, Kakrail, Dhaka, Bangladesh) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত কোন প্রতিষ্ঠান নয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর ধারা ৩৯(১) অনুযায়ী উক্ত প্রতিষ্ঠানের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের কোন এখতিয়ার নেই। এছাড়াও ইউজিসি, ১১ ডিসেম্বর  ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রির বৈধতা বিষয়ক স্পষ্টিকরণ চিঠিতে  পুনরায় তার ডিগ্রিটি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। একই সাথে ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা_১ হতে জারিকৃত চিঠির মাধ্যমে মালা খানের পিএইচডি ডিগ্রিটি অবৈধ বলে ঘোষণা করে। 

মালা খানের পিএইচডি সুপারভাইজার ড. এস এম ইমামুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের একজন অধ্যাপক যিনি পিএইচডি চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের পূর্ণকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারের অফিস অনুযায়ী তিনি American World University এর রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন না যা মালা খান তার পিএইচডি থিসিসে অসত্যভাবে উপস্থাপন করেন। 

মালা খানের পিএইচডি কো-সুপারভাইজার ছিলেন তার স্বামী কে এম মোস্তফা আনোয়ার যার রসায়ন বিষয়ে কোন স্বীকৃত ডিগ্রি নেই। পিএইচডি থিসিসটি ২০০৮-২০০৯ সালে সম্পাদিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের একটি Special Allocation (Formulation of a draft national strategy paper on developing chemical metrology infrastructure of Bangladesh) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত ফলাফলের হুবহু নকল, যা পিএইচডি ডিগ্রির থিসিস পেপার হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। এছাড়াও তার থিসিস পেপারটিতে একটি ইউরোপিয়ান (ক্রোয়েশিয়া) দেশের মেট্রলজি হস কেমিস্ট্রি কান্ট্রি রিপোর্টের তথ্য হুবুহু কপি পেস্ট করেন। 


ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রী ও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত মালা খান বিআরআই সিএম এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বিপুল অংকের টাকা লুটপাট করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সবশেষ অডিট রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে ২৭ কোটি টাকার আপত্তি এসেছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মহাপরিচালক অনুপম বড়ুয়া ঢাকা মর্নিং নিউজকে জানান, মালা খানের বিরুদ্ধে দুর্ণীতির প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি সঠিক। অডিট আপত্তিসহ সব তথ্যপ্রমাণ জমা দেয়ার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।